১৯৯১ সাল, জোরহাট তখনও শান্ত গলি আর চেনা মুখের এক শহর ছিল। এমন একটা জায়গা যেখানে প্রত্যেকে হয়তো একে অপরকে চিনত বা অন্তত চেনার দাবি করত। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে ছিল ‘সিম্ফনি মিউজিক’, রাজেন দা-র সঙ্গীতের বিনয়ী মন্দির। এটা শুধু একটা দোকান ছিল না, এটা ছিল জোরহাটের সঙ্গীত জগতের প্রাণকেন্দ্র। অ্যামপ্লিফায়ার, অডিও মিক্সার, সব আকারের স্পিকার, জোরহাটে যারা গান-বাজনা করত, তাদের একবার হলেও সিম্ফনি মিউজিকের দরজায় আসতে হতো।
পাশে ছিল রাজিবের চায়ের দোকান, যা প্রতি বিকেলে গরম সিঙ্গাড়া আর মচমচে আলুর চপ তৈরি করত। শিল্পীরা আসতেন বাদ্যযন্ত্রের জন্য, কিন্তু থেকে যেতেন আড্ডার টানে। সিম্ফনি নিছক দোকান ছিল না; এটি ছিল একটি মঞ্চ, একটি সুযোগ, এটি যেন অপেক্ষায় থাকতো একটি স্বপ্নের ফিসফাস শোনার।
সেখানেই ১৯৯১ সালের এক অলস বিকেলে আমার ভাই আমার সঙ্গে জুবিনের পরিচয় করিয়ে দেয়। দু’জনেই ছিল জে.বি. কলেজের ছাত্র, এবং সেদিন সন্ধ্যায় ছিল ফ্রেশার্সের রাত, বার্ষিক প্রথা অনুযায়ী যেখানে শিল্পীরা তাদের সেরাটা দিয়ে যেত সহপাঠীদের মনে ছাপ ফেলার আশায়।
জুবিন সাইকেলে করে সিম্ফনিতে এলেন, হাওয়ায় উড়ছিল কোঁকড়া লম্বা চুল। আমার কিশোর মনে মনেহলো যেন, সে সোজা কোনো সিনেমা থেকে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে এসেছে। পরে এই চুলের জন্যই তাঁর নাম হয়েছিল “সাবা্তিনি,” কিন্তু তাঁর সহজ হাসি আর চটজলদি রসিকতা আমার মতো একজন অন্তর্মুখী মানুষকে মুহূর্তেই স্বস্তি দিয়েছিল।
তিনি বললেন, “শো দেখতে এসো। আমি কিবোর্ড বাজাব… আর নিজের কিছু গান গাইব।”
“নিজের গান?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ। নিজেই লিখেছি আর সুর করেছি। দেখা যাক, লোকে কী ভাবে।”
তিনি আমাদের ৮০-এর দশকের স্কুলের বন্ধুদের পরিচিত গন্ডির কেউ ছিলেন না, বরং যেন গল্পের মধ্যে নতুন এক চরিত্র। তিনি ছিলেন শহরের নতুন ছেলে, এবং নিজেকে উপস্থাপন করতেন বেশ খোলামেলা আড়ম্বরের সঙ্গে। তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী এবং তাঁর অপ্রথাগত পোশাকে ছিলেন অন্যদের থেকে আলাদা। এমনকি তখন থেকেই তাঁকে এমন কেউ মনে হতো, যিনি ঠিক কী করছেন বা অন্তত সঙ্গীত তাঁকে কোথায় নিয়ে যাবে তা জানেন।
প্রথম দেখায়, আমি বেশ কৌতূহলী হয়েছিলাম—একটু দ্বিধাগ্রস্ত, একটু মুগ্ধ। উদ্ধত আর আত্মবিশ্বাসী হওয়ার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। গিটারের কর্ড নিয়ে সবেমাত্র আনাড়িভাবে নাড়াচাড়া করতে শুরু করেছেন। কিছুটা উচ্চকিত, লম্বা চুলের, স্বপ্নভরা চোখের এই ছেলেটির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে থাকা কঠিন ছিল।

সেই রাতে, আমি প্রথম তাঁর গান “প্রীতির সুবাসে” শুনলাম। গানটি ছিল ধীর, কোমল, হয়তো সেই অনুষ্ঠানের জন্য একটু বেশিই শান্ত। কিন্তু জুবিনের কণ্ঠস্বর আকাশ ছুঁয়েছিল এবং তাঁর গায়কী ছিল স্পষ্টতই আন্তরিক। শ্রোতারা এবং অন্য শিল্পীরাও তা বুঝতে পেরেছিল সেদিন।
অনেকেই জানেন না, কিন্তু সেই বছরই জুবিন লুনা সোনোয়ালের মতো সেই সময়ের শিল্পীদের সাথে কিবোর্ড বাজাতে শুরু করেন, এবং পরে স্বয়ং জিতুল সোনোয়াল-এর সাথেও। সেসময় আমরা নতুন সুরের জন্য ক্ষুধার্ত ছিলাম, এমন কোনো সুর যা layered, জটিল এবং নতুন! জুবিন তাঁর কম্পোজিশনে জটিল কর্ড ব্যবহার করতেন, কোথাও augmented fifth, আবার কোথাও added ninth; যদিও তিনি মাঝেমধ্যে বলতেন যে কর্ডের নাম তিনি জানেন না, শুধু তাঁর যা মনে হয় তাই বাজান। সেই ছোট ছোট স্পর্শগুলো ছিল অসমীয়া সুরের মধ্যে জ্যাজ়-এর মতো ফিসফাস।
এরপর এল ১৯৯২ সাল। জুবিনের প্রথম অ্যালবাম ‘অনমিকা’ ফিসফিস করে মুক্তি পেল, আর আঘাত হানল ঝড়ের বেগে। শিরোনামের গানটি লোকে বলত ‘অনমিকা’ নামের একটি মেয়েকে নিয়ে লেখা, যদিও আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভিন্নমত ছিল। একই অ্যালবামের “প্রীতির সুবাসে” এবং “মনোর নিজানত” ছিল একপাক্ষিক প্রেম এবং হৃদয়ের কষ্টের গান।
রাতারাতি, জুবিন কেবল একটি নাম রইলেন না, তিনি হয়ে উঠলেন আমাদের কণ্ঠস্বর। আসাম জুড়ে প্রতিটি ক্যাসেট প্লেয়ারে তাঁর গান বাজতে শুরু করল।
কিন্তু ৯০-এর দশক আসামে কেবল সঙ্গীত আর সুরের দশক ছিল না। আসাম আন্দোলনের পরের দশকটি রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রপতি শাসন এবং অপারেশন বজরং নিয়ে এসেছিল আমাদের এলাকায়। তরুণ ছেলেরা হারিয়ে যাচ্ছিল, কেউ কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে, অন্যরা এমন অন্ধকারে যা থেকে আর কখনও ফেরা হয়নি। অনেকে বন্দুক তুলে নিয়েছিল। আর আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তুলে নিয়েছিল গিটার।

(ছবি: আয়ুষী শ্রীবাস্তব/ইন্ডিয়া টুডে)।
১৯৯৩ সালের মধ্যে আমি দিল্লি চলে আসি। আমার ভাই জোরহাটের মিউজিক সার্কেলে আরও গভীরভাবে জড়িয়েছিল, তারপর অবশেষে গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটি, এবং পরে অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। আর জুবিন? তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ছিলেন, যে পথ তারকাখ্যাতি দিয়ে সাজানো। সেই দশক জুড়ে তিনি একের পর এক অ্যালবাম প্রকাশ করেন: মায়া, আশা, মুক্তি, শিকলি, এমনকি তাঁর প্রথম হিন্দি অ্যালবাম ‘চাঁদনি রাত’ সহ আরও অনেক। তিনি ছিলেন অদম্য, তাকে থামানো যেন অসম্ভব ছিল তখন।
অনেক বছর কেটে গেল। ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে আমি আবার জুবিনকে দেখি। এবার আর মঞ্চে নয়, দিল্লির ময়ূর বিহারে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে। আমাদের সাধারণ বন্ধু পাপন-এর সৌজন্যে তিনি কয়েক দিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সেখানে কোনো তারকাময় জীবন ছিল না। কোনো ক্যামেরা ছিল না। সেই দিনগুলি ছিল চিন্তামুক্ত। আমরা তিনজন পুরোনো বন্ধু, আর জুবিন, যিনি নিজের তারকাখ্যাতি ঝেড়ে ফেলে আমাদের একজন হয়ে উঠেছিলেন। শুধুমাত্র একদল যুবক ছেলে যারা ভালো সময় কাটাচ্ছে, হাসি-মজা করছে, জীবন ও অন্যান্য অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছে।
একবার রাতের খাবারের সময় তিনি বলেছিলেন, “আমি বিহু, বরগীত, লোকগীত গাওয়ার বিষয়টি ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এগুলিই আমাদের মনন তৈরি করে, আমাদের অসমীয়া পরিচিতি দেয়।”
সেই সময় আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে অনেক অতিথি আসতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী, হৃদয়, তাঁর খুড়তুতো ভাই জয় (বড়ুয়া), ডেভিড বেকার, সনি রাও এবং অনুপম কটকী, এরকম অনেক নাম, অনেক মুখ, অনেক কর্ড, অনেক হাসি। আমরা একসঙ্গে রান্না করতাম, রাতভর জ্যাম করতাম। কোনো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। সব কিছু ধরে রাখার জন্য ফোন বা ক্যামেরাও ছিল না। কিন্তু স্মৃতিগুলো? এখনও একদম তাজা।
২০০৬ সালে মুম্বাইয়ের একটি টিভি স্টুডিওতে আমার সঙ্গে জুবিনের আরও একবার দেখা হয়, যেখানে আমি কাজ করতাম। “ইয়া আলী”-এর সাফল্যের পর তিনি বলিউড সুরকার প্রীতম-এর সাথে সেখানে ছিলেন।
দেখার সাথেসাথেই তিনি চোখ বড় করে বললেন, “আরে, তুমি এখানে কী করছো? ফোন করোনি কেন? বাড়িতে ডিনারে এসো। আমি অপেক্ষা করবো!”
সত্যি বলতে, আমাকে কোনো বিকল্প দেওয়া হয়নি, এমন আমন্ত্রণ যা এড়াতে পারবেন না। আর সত্যিটা হলো, আমরা সেই অর্থে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম না তখন। জুবিন ছিল আমার ভাইয়ের বন্ধু, বন্ধুদের বন্ধু, কেউ জোরহাটের, যেমন গৌতম চক্রবর্তী (ভেডো) এবং বাবা রশিদ, আবার কেউ গুয়াহাটির, যেমন পাপন। কিন্তু জুবিন মানুষ হিসেবে এমনই ছিলেন, সবসময় সহজলভ্য, সবসময় উষ্ণ। সবসময় খোলা মনের, তাঁর বাহু, তাঁর হৃদয়, তাঁর বাড়ি, তাঁর স্মৃতি সবকিছু সবার জন্য উজাড় করে রাখা। আর তিনি মানুষকে মনে রাখতেন। আপনি পুরোনো বন্ধু হন বা একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত, তিনি আপনাকে গুরুত্ব দিতেন।
তাঁর গান ছিল মানুষটির মতোই বন্ধনমুক্ত। তা শুধু বিভিন্ন ঘরানার সীমাই অতিক্রম করত না, ভাষার বাধা টপকে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ত। এত উঁচুতে ওঠার পরেও তিনি কখনও মাটির টান ভোলেননি। তাঁর গানের কথা কেবল সুর আর ছন্দের চেয়েও বেশি কিছু বহন করত, বহন করত গভীর অর্থ। প্রায়শই সুরের আড়ালে লুকিয়ে থাকত বার্তা, শক্তির বিরুদ্ধে নীরব অভিযোগ, সমাজের সাহসী প্রতিচ্ছবি এবং নিজেদের শেকড় মনে রাখার আহ্বান।
রোমান্টিক ব্যালাড তাঁকে খ্যাতি এনে দিলেও, ‘অনমিকা’ তাঁকে ঘরে ঘরে পরিচিত নাম করে তুললেও, জুবিনের উত্তরাধিকার আরও অনেক গভীর। পপ-তারকার খ্যাতির আড়ালে বাস করত তাঁর সময়ের এক প্রচণ্ড ইতিহাসবেত্তা। “সুনেরে সজুয়া পোজা,” ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তাঁর এমন একটি গান যা সহিংসতা ও অনিশ্চয়তায় ক্ষতবিক্ষত আসামের প্রতি এক মর্মস্পর্শী শ্রদ্ধাঞ্জলি। জুবিনের নিজের লেখা এই গানটি একটি পুরো প্রজন্মের দুঃখকে তুলে ধরেছিল, যে প্রজন্ম অস্থিরতার ছায়ায় বেড়ে উঠেছিল।
গানের কিছু অংশ:
বুরহি আইর জোহালতে চকুলু হুকাই (ঠাকুমার উনুনে চোখের জল শুকিয়ে যায়)
দেউতারু একে দোখা পদুলিলে চাই (বাবা উঠোনের দিকে চেয়ে থাকেন)
বহুদিন হলো সুরু বুপার মুখ দেখা নাই (অনেক দিন হলো ছোট ছেলেটির মুখ দেখা হয়নি)
সেনেহির আকাশত আজি জুন তরা নাই (স্নেহের আকাশে আজ চাঁদ নেই, তারা নেই)
হালোর গরু গুহালিতে পঠারু হুকাই (হালের বলদ গোয়াল ঘরে, খেত শুকিয়ে যায়)
রাতি হলেই গুলির শব্দ রজন-জনাই (রাত নামলেই গুলির শব্দে আকাশ কেঁপে ওঠে)
সুনেরে সজুয়া পোজা জহি খহি যায় (সোনা দিয়ে সাজানো ঘর ভেঙে যায়)
কুনে আজি সজিবোহি পারিবো দুনাই (কে আজ তা আবার গড়ে তুলবে?)
জুবিনের কণ্ঠে মানুষের দুঃখের প্রতিধ্বনি ছিল, আবার তাঁর সঙ্গীতে সবসময় আশা থাকত। এক গভীর, দৃঢ় আশা।
২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর, আমার ভাই প্রাঞ্জল অপ্রত্যাশিতভাবে মারা যায় অস্ট্রেলিয়াতে। আমরা সবাই খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু পরের দিন সন্ধ্যায়, পৃথিবীর এক দূর কোণে, জুবিন মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সরাসরি দর্শকদের সামনে তিনি তাঁর পুরোনো বন্ধুকে উৎসর্গ করে গাইলেন ‘মায়াবিনী’।
তিনি বলেছিলেন, “আজ রাতে আমি এই গানটি আমার পুরোনো বন্ধু প্রাঞ্জলকে উৎসর্গ করছি। আমরা ওকে ‘গুগি’ বলে ডাকতাম।”
সেদিন রাতে একের পর এক ফোন আসতে থাকল; শুধু কল, মেসেজ নয়, এল বহু মানুষের বলা সেই গল্প। তারা জানাল, জুবিন সেই রাতে ‘মায়াবিনী’ গেয়েছিলেন এমন এক তীব্র আবেগ দিয়ে, যা বহু বছর ধরে তারা দেখেনি। কেউ কেউ বলেছিল, এটি তাঁর সবচেয়ে আন্তরিক পরিবেশনাগুলোর মধ্যে একটি ছিল। সেই মুহূর্তে, সেই গানের মাধ্যমে, আমার ভাই আবার বেঁচে উঠেছিলেন, ঠিক যেমন আমাদের অনেকেই জুবিনের সঙ্গীতের মাধ্যমে বারবার বেঁচে থেকেছি।
জুবিন এমনই ছিলেন।
বেপরোয়া, বিদ্রোহী এবং স্পষ্টভাষী। তবে একই সঙ্গে বিনয়ী, গভীরভাবে সংবেদনশীল এবং এমনভাবে বিশ্বস্ত যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। হয়তো তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই। তাঁর কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে গেছে। তাঁর প্রকাশ্য তীব্র সমালোচনা এবং কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্ভীক কটাক্ষ এখন শুধুই স্মৃতি। কিন্তু তাঁর সঙ্গীত, আহ্, সেই সঙ্গীত, তা কখনও ম্লান হবে না।
জুবিন গার্গ শুধু একজন আইকন নন। তিনি একজন কিংবদন্তি এবং তার চেয়েও বেশি, তিনি একটি অনুভূতি, যা প্রতিটি অসমীয়া হৃদয়ে গেঁথে আছে।
তাঁর মতো আর কেউ আসবে না। এই জীবনে না।
NE NEWS-এর জন্য স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি পাঠিয়েছেন তার বন্ধু প্রীতম বরা (সিনিয়র অটোমোটিভ সাংবাদিক)।





