পেকে উঠছে উপমহাদেশের ভূরাজনীতির বিষফোঁড়া

গত মে মাসে “লীগের ‘আত্মিয়’, বিএনপি-জামাতের ‘ঘনিষ্ঠ’, ইউনূসের ‘গ্যারান্টার’, ভারতের ‘নির্ভরযোগ্য’ …..আসলে জেনারেল ওয়াকার কাদের লোক?” শিরোনামের লেখাটিতে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। চার মাস পরে আজও সন্দিহান। তিনি নিপূণ দক্ষতায় সব কুল রক্ষা করে চলেছেন।

আগামী ১৩ই থেকে ১৬ই অক্টোবর ভারতে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের শান্তিবাহিনী মিশনে সেনা প্রেরণকারী ৩০টি দেশের সেনাবাহিনীর প্রধানদের নিয়ে সম্মেলন হতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে ‘সাউথ এশিয়া কাউন্টার টেররিজম কনফারেন্স ২০২৫’ এর একটি সম্মেলনও হবে। ওয়াকার-উজ-জামান এই দুটি সম্মেলনে তার যোগদান বাতিল করেছেন। তার পরিবর্তে আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ড-এর জিওসি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমানের অংশ নেওয়ার কথা।

২ অক্টোবর জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকারী জামায়াতের নায়েব-এ-আমীর আব্দুল্লাহ মোহাম্মাদ তাহের নাকি দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে নেমে ভারতীয় সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই খবরের ‘সত্যতা’ প্রমাণে সামাজিক মাধ্যমে দুজনের করমর্দনের একটি ছবিও ছাপা হয়েছে। ‘রিউমারস্ক্যানার’ ছবিটিকে ফেক বলেছে। একইসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেখা করেছেন সেনাপ্রধান ওয়াকারের সঙ্গে। এই দুটি খবরকে স্ক্রুপ করে মিডিয়ায় জোর আলাপ-‘ভেতরে ভেতরে বড়সড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে’!

এইসব খবরের ভীড়ে আসল খবর হলো; ৫ অক্টোবর, ২৫’ India.com-এ গাজী আব্বাস শহীদ-এর ‘ভারতবিরোধী ইউনূস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য বাংলাদেশকে উন্মুক্ত করে দিলেন, মুনিরের শীর্ষ লেফটেন্যান্ট ঢাকা সফরে আসছেন…, ভারতের জন্য উদ্বেগ…’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে―”মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঢাকায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক পুনরুত্থিত হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং আইএসআই বাংলাদেশে প্রবেশ করায় ভারতের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি গত বছরের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতায় আসার পর থেকে নিজেকে ভারতবিরোধী ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রকাশ করেছেন, তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। ইসলামাবাদের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা ঘন ঘন ঢাকা সফর করছেন।

একজন শীর্ষ পাকিস্তানি তিন তারকা জেনারেলের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি চার সদস্যের প্রতিনিধিদল ৬ অক্টোবর বাংলাদেশে যাচ্ছে, যার লক্ষ্য ইসলামাবাদ এবং ঢাকার মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা।

জয়েন্ট স্টাফের মহাপরিচালক (ডিজি জেএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল তাবাসসুম হাবিবের নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধিদল সোমবার ঢাকায় আসবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের (এএফডি) আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরকারী পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের মধ্যে একজন কমোডোর এবং পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন মেজর পদমর্যাদার স্টাফ অফিসারও থাকবেন বলে জানা গেছে।

‘এএফডি’ বাংলাদেশের তিনটি প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি যৌথ সমন্বয় সদর দপ্তর এবং যুদ্ধকালীন সময়ে একটি যৌথ কমান্ড সেন্টার হিসেবে কাজ করে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয় থেকে পরিচালিত হয় এবং ঢাকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে। “

এদিকে আফগানিস্তানে বাগরাম বিমান ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তালেবান। ট্রাম্প মে মাসে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পরই ওই ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা জানিয়েছিল। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে গত বছরের আগস্টে, তা.লে.বা.ন.রা বাগরাম দখলের তৃতীয় বার্ষিকী উদযাপন করে পরিত্যক্ত মার্কিন যুদ্ধাস্ত্রের বিশাল সামরিক প্রদর্শনীর মাধ্যমে, যা হো/য়াই/ট হাউসের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ট্রাম্প বারবার জো বাই ডে নের সমালোচনা করেছেন দেশের দীর্ঘতম যুদ্ধের পর মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের সময় তার ‘চরম অযোগ্যতার’ জন্য।

তালেবানরা জানিয়েছে-‘এটা মনে রাখা উচিত যে, দোহা চুক্তির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে ‘তারা আফগানিস্তানের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ বা হুমকি দেবে না এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না, তাই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে।

আমেরিকার কী দরকার পড়ল বাগরাম ঘাঁটি দখলে নেওয়ার? কারণ খুব সোজা; বাগরাম ঘাঁটি থেকেই ২০২১ সালের আগে তারা চীনকে তাদের মিসাইল রেঞ্জে রেখে হুমকির ওপরে রাখত। এখন বাগরাম ঘাঁটি পুর্নদখল করে সেখানে বেজক্যাম্প বসাবে। একই সময়ে ট্রাম্প মুনিরের কাছ থেকে সামরিক ঘাঁটি চেয়েছেন। ট্রাম্প অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটি এবং সমুদ্রবন্দরগুলোতে প্রবেশাধিকার চেয়েছেন (FP News Desk • June 19, 2025)

ট্রাম্প ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনীরকে ভোজসভায় দাওয়াত করে খাইয়ে দাইয়ে হাতে কয়েক মিলিয়ন ডলার গুজে দিয়ে ঘাঁটি বসানোর জায়গা নিয়ে নেবে। যদিও ইতোমধ্যে পাকিস্তানে আমেরিকার ৯টি প্রতিষ্ঠিত এয়ারবেস রয়েছে, যেখান থেকে চীনের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর মিসাইল রেঞ্জে পড়ে।

আফগানিস্তানের ‘বাগরাম’, পাকিস্তানের ৯ টির সঙ্গে নতুন আরও কয়েকটি এয়ারবেস দিয়ে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনসহ শিলখালি বা মহেশখালিতে ঘাঁটি গেড়ে চীনের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। একইসঙ্গে এই তিনটি দেশে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে ভারতকে শাসনে রাখতে চায়।

এইসব ‘সম্ভবানার’ মধ্যে গত সপ্তাহে ভারতের সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদী ‘করাচি দখল’-এর প্রত্যয় ব্যক্ত করে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। ভারত থেকে বারংবার বলা হচ্ছে―’Operation Sindoor’ has not stopped, there is a temporary pause and ‘Operation Sindoor-2’ may start at any time’।

এর ওপর আরাকান আর্মি চিফ স্পষ্টতই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দিকে আঙ্গুল তুলেছে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের টেরিটোরিতে কয়েকটি স্থানে ‘আরসা’র হামলার পরে।

ওদিকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর জ্বলছে। সেখানকার বিক্ষোভ নিয়ে আমাদের মিডিয়ায় তেমন কোনও খবর নেই। বাংলাদেশ থেকেও কাশ্মীরী ভাইদের জন্য ‘মার্চ টু কাশ্মীর’ ঘোষণা নেই। অসমর্থীত সূত্রমতে এখন পর্যন্ত বিক্ষোভে নিহতের সংখ্যা একশ’ ছাড়িয়েছে। আহত শত শত।

অক্টোবরের শুরুতে, পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর (আজাদ কাশ্মীর) -এ সরকারবিরোধী সহিংস বিক্ষোভ কর্তৃপক্ষ এবং নাগরিক অধিকার জোটের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি বাতিল হয়েছে।

ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের জোট জম্মু কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি (JAAC) এর নেতৃত্বে, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং ক্ষমতাবান ধনীক শ্রেণীর সুযোগ-সুবিধার বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভের কারণে এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল।

মূল দাবিগুলো ছিল: ভর্তুকিযুক্ত গম এবং বিদ্যুতের শুল্ক হ্রাস, কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা এবং ব্যয়বহুল সরকারি গাড়ি বন্ধ করা, রাজনৈতিক সংস্কার এবং উন্নত জনসেবা নিশ্চিত করা।

সাম্প্রতিক সময়ে মুহাম্মাদ ইউনূসের টালমাটাল অবস্থা, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্রমাগত বন্ধু হারানো, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের ৫জনসহ মোট ৭ জন এমপি ও আইনজীবী ব্রিটিশ সরকারের কাছে এবং জাতিসংঘে ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘আইনের অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিশেষ দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণের’ অভিযোগ করে ‘ব্যবস্থা নিতে’ অনুরোধ করেছে।

সুতরাং এটা মনে করার কারণ নেই যে ইউনূস এবং তার ‘বিদেশি নাগরিকদের ক্লাব’ সহিসালামতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে যার যার পূর্বপেশায় ফিরে যাবেন। মার্কিন ডিপস্টেটের হাতে এখনও অনেক ষড়যন্ত্র মওজুদ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও ডজন ডজন স্বার্থবাদী খেয়োখেয়ি-কামড়াকামড়ি অবশিষ্ট আছে।

Tags :

Monjurul Haque

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025