ভূমিকম্পে হতাহত নারীদের উদ্ধার করেনি তালেবান কর্মীরা

গত রবিবার আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি এলাকায় ৬ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে। এ ঘটনার পর উদ্ধারকর্মীরা যখন বিবি আয়েশার গ্রামে পৌঁছায়, তখন পেরিয়ে গেছে ৩৬ ঘণ্টার বেশি সময়। কিন্তু তাদের দেখে আয়েশার মনে স্বস্তি আসেনি, বরং তাঁর ভয় বেড়ে গিয়েছিল! কারণ, উদ্ধারকারী দলে একজনও নারী ছিল না।

তালেবান সরকারের কঠোর সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী, পরিবারের সদস্য নন এমন কোনো পুরুষ ও নারীর মধ্যে শারীরিক স্পর্শ নিষিদ্ধ।

কুনার প্রদেশের আন্দারলুকাক গ্রামের ১৯ বছর বয়সী আয়েশা জানান, পুরুষ উদ্ধারকারীরা আহত পুরুষ ও শিশুদের দ্রুত বের করে নিয়ে এসে তাদের চিকিৎসা দিচ্ছিল। কিন্তু তিনি ও অন্যান্য আহত নারী ও কিশোরীদের, যাদের মধ্যে অনেকে রক্তাক্ত ছিল, তাদের এক পাশে ঠেলে দেওয়া হয়।

আয়েশা বলেন, ‘তারা আমাদের এক কোণে জড়ো করে আমাদের কথা ভুলে গেল।’ কেউ তাদের সাহায্যের প্রস্তাবও দেয়নি, তাদের কী প্রয়োজন, তা-ও জিজ্ঞেস করেনি, এমনকি কাছেও আসেনি।

একই প্রদেশের মাজার দারাতে উদ্ধারকাজে যাওয়া ৩৩ বছর বয়সী পুরুষ স্বেচ্ছাসেবক তাহজিবুল্লাহ মুহাজিব জানান, শুধু পুরুষদের নিয়ে গঠিত দল ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নারীদের টেনে বের করতে ইতস্তত করছিল। অন্য গ্রামের নারী উদ্ধারকর্মীরা না আসা পর্যন্ত আহত নারীরা পাথরের নিচে আটকা পড়ে ছিল। মুহাজিব বলেন, মনে হচ্ছিল, নারীরা যেন অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য। পুরুষ ও শিশুদের প্রথমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু নারীরা আলাদা হয়ে বসে ছিল, চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করছিল। যদি কোনো পুরুষ আত্মীয় উপস্থিত না থাকেন, তাহলে উদ্ধারকর্মীরা মৃত নারীদের পোশাক ধরে টেনে বের করে আনছিল, যাতে শরীরে কোনো স্পর্শ না লাগে।

আফগান সরকারের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৬ মাত্রার এ ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। আহত প্রায় ৩ হাজার ৬০০। সাহায্য সংস্থা ও মানবিক সংগঠনগুলো বলছে, এ দুর্যোগের সময় নারীদের নিয়ে সরকারের প্রতিক্রিয়া আফগানিস্তানে নারী ও মেয়েদের প্রতি চরম বৈষম্যের প্রতিফলন।

আফগানিস্তানে জাতিসংঘের নারীবিষয়ক প্রতিনিধি সুসান ফার্গুসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘নারী ও মেয়েরা আবারও এ দুর্যোগের মূল আঘাত সহ্য করবে, তাই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, উদ্ধার ও পুনর্বাসনের মূল কেন্দ্রে যেন নারীদের বিষয়টি থাকে।’

তালেবান সরকার হতাহতদের লৈঙ্গিকভিত্তিক কোনো তথ্য প্রকাশ না করলেও ডজনখানেক চিকিৎসক, উদ্ধারকর্মী ও ভুক্তভোগী নারী সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের আঘাতের চেয়ে অবহেলা ও একাকিত্বের কারণে নারীরা আরও বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।

আফগানিস্তানে স্বাস্থ্যকর্মী, বিশেষ করে, নারী স্বাস্থ্যকর্মীর তীব্র ঘাটতি রয়েছে। গত বছর তালেবান নারীদের চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশোনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। তালেবান পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শরাফত জামান অবশ্য স্বীকার করেছেন, ভূমিকম্পবিধ্বস্ত এলাকায় নারী স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব রয়েছে। তবে তিনি দাবি করেন, কুনার, নানগারহার ও লাগমান প্রদেশের হাসপাতালগুলোয় প্রচুর নারী চিকিৎসক ও নার্স কাজ করছেন।

তালেবান শাসনে নারীর দুর্দশা

চার বছর আগে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানে নারীদের ওপর বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মেয়েদের ষষ্ঠ শ্রেণির পর স্কুলে যাওয়া নিষিদ্ধ, নারীরা কোনো পুরুষ সঙ্গী ছাড়া দূরে কোথাও যেতে পারে না এবং বেশির ভাগ চাকরি থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘে কর্মরত আফগান নারীরাও গুরুতর হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যার ফলে এ বছর তাঁদের অস্থায়ীভাবে বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আয়েশা জানান, প্রায় চার দিন পরও তাঁদের গ্রামে কোনো নারী ত্রাণকর্মী পৌঁছায়নি। তিনি ও তাঁর তিন বছরের ছেলে গত তিন রাত খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছেন।

আয়েশা বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে ও আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন, কিন্তু সেই রাতের পর আমি বুঝতে পেরেছি, এ দেশে নারী হওয়া মানে আমাদের স্থান সবার নিচে।’

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025