বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর যেখানে বিদেশ ভ্রমণে সহজলভ্যতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশি ভ্রমণকারী ও কর্মীদের জন্য আন্তর্জাতিক ভিসা প্রাপ্তি ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। বিভিন্ন দেশ অনানুষ্ঠানিকভাবে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে অথবা “ওভারস্টে” (ভিসার মেয়াদ শেষেও অবস্থান) অভিযোগের কারণে সীমিত সংখ্যক ভিসা ইস্যু করছে। এর ফলে হাজার হাজার চিকিৎসা, ব্যবসা, সাধারণ পর্যটক এবং বিদেশে কর্মসংস্থান প্রত্যাশী বাংলাদেশি নাগরিকরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
ভিসার কড়াকড়ি: পর্যটন ও কর্মসংস্থান খাতে তীব্র প্রভাব
আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরদের মতে, এই সংকট শুধু ভ্রমণকারীদেরই নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), মালয়েশিয়া এবং ওমানের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশি কর্মীদের কাজের সুযোগও মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (BOTOF) জানিয়েছে, গত ডিসেম্বর থেকে তাদের বিক্রি ৬০% কমে গেছে, যা এই খাতের প্রায় ৪২,০০০ কর্মীর জীবন-জীবিকাকে সরাসরি প্রভাবিত করেছে।
ভারতের ভিসা নীতিতে পরিবর্তন
আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, ভারত, যা বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য একসময় প্রধান গন্তব্য ছিল, সরকার বদলের পর বাংলাদেশি ভ্রমণকারীদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আগে ভারত প্রতি বছর প্রায় ১৪ লক্ষ ভিসা ইস্যু করলেও, এখন শুধুমাত্র জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের জন্য হাতে গোনা কিছু ভিসা দেওয়া হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম জানিয়েছেন, জনবল সংকটের কারণে আবেদন কম নেওয়া হচ্ছে এবং তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা করছেন।
অন্যান্য দেশের কড়াকড়ি: একটি বিস্তারিত চিত্র
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ভিসা স্থগিতাদেশ: ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং লাওস সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ওভারস্টের অভিযোগের কারণে বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ভিসা ইস্যু সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। BOTOF-এর সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান উল্লেখ করেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পর্যটন ভিসার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে কর্মী পাঠাচ্ছে, যার ফলে বৈধ ভ্রমণকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ট্যুর অপারেটর তাসলিম আমিন শোভন জানান, গত দুই বছরে শুধু ভিয়েতনামে ৩০,০০০-এর বেশি বাংলাদেশি অবৈধভাবে অবস্থান করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে দূতাবাসগুলোর সাথে যোগাযোগ করছে।
- মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মী ভিসায় জটিলতা: সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) গত জুলাইয়ে সরকার পতন আন্দোলন সমর্থনে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিক্ষোভের পর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওমানে অবৈধ ভিসা ব্যবসা এবং মালয়েশিয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির কারণে শ্রম বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে আমিরাতে কর্মী নিয়োগের সংখ্যা গত এক বছরে ৫,০০০ থেকে মাত্র ২৩ জনে নেমে এসেছে, এবং ওমানে ১,২৭,০০০ থেকে মাত্র ৩৫৮ জনে নেমে এসেছে।
- থাইল্যান্ডের ই-ভিসা জটিলতা: ২ জানুয়ারি থেকে থাইল্যান্ডে ই-ভিসা পদ্ধতি চালুর পর থেকে ভিসা প্রাপ্তি কঠিন হয়েছে। প্রতিদিন অনুমোদিত ভিসার সংখ্যা ৮০০ থেকে কমে ৪০০-তে নেমে এসেছে। ই-ভিসা আবেদনের ফি প্রদানে জটিলতা দেখা দিচ্ছে, বিশেষ করে গ্রুপ ভিসার ক্ষেত্রে। থাই দূতাবাস জানিয়েছে, এই সমস্যা ফেব্রুয়ারির আগে সমাধান হবে না।
- ইউরোপীয় ও তুরস্কের ভিসা সীমিতকরণ: ইউরোপীয় দেশগুলোর ভিসা সীমিতকরণের কারণে তুরস্কে ভ্রমণও কমে গেছে। BOTOF-এর সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান জানান, তার কোম্পানি আগে যেখানে মাসে ৩০ জন পাঠাতো, সেখানে জানুয়ারিতে মাত্র ১২-১৩ জন ভ্রমণ করেছেন, যা প্রায় ৫০% হ্রাস। ব্যবসা ও আনন্দ ভ্রমণ উভয়ই উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
- ইন্দোনেশিয়ার ভিসা প্রক্রিয়া কঠিন: ইন্দোনেশিয়ার ভিসা পেতে এখন দেড় মাস পর্যন্ত সময় লাগছে এবং ভিসা ফি প্রায় ১৪,০০০ টাকা। আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার ও স্থানীয় গ্যারান্টরের আমন্ত্রণপত্র প্রয়োজন হচ্ছে। পূর্বে বাংলাদেশিরা ইন্দোনেশিয়ায় অন-অ্যারাইভাল ভিসা পেতেন, যা এখন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ।
জনপ্রিয় গন্তব্যের বর্তমান অবস্থা
- ভারত: একসময় ৪০-৪৫% বাংলাদেশি পর্যটকের গন্তব্য ছিল, এখন ভিসা সীমিত।
- থাইল্যান্ড: ১৫-২০% বাংলাদেশি ভ্রমণকারীর গন্তব্য, কিন্তু ই-ভিসা জটিলতায় ভিসা প্রাপ্তি কঠিন।
- মালয়েশিয়া: ১০-১৫% বাংলাদেশি পর্যটকদের গন্তব্য।
- সিঙ্গাপুর: ৫-১০% বাংলাদেশি পর্যটকদের গন্তব্য।
- মধ্যপ্রাচ্য (UAE, সৌদি আরব, ওমান): ১০-১৫% বাংলাদেশি পর্যটকদের গন্তব্য, কিন্তু কর্মী ভিসায় কড়াকড়ি।
- ইউরোপ: ৫-৮% বাংলাদেশি পর্যটকদের গন্তব্য, কিন্তু ভিসা সীমিত।
- নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান: এই দেশগুলোতে বর্তমানে ভিসা প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে মসৃণ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দাবি করেছিল যে তারা বিভিন্ন দেশের ভিসা সেন্টার ঢাকায় নিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশিরা আগের থেকে অনেক সহজে ভিসা পাবেন। অনলাইনে এই বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই ভিসা কড়াকড়ির ফলে বিদেশে পড়াশোনা, চিকিৎসা, ব্যবসা বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক হাজার হাজার বাংলাদেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
এই সংকট কি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, নাকি এটি কেবল একটি অন্তর্বর্তীকালীন সমস্যা? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অনিশ্চিত।
সূত্রঃ ডয়চে ভেলে, দা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড