গত এক বছর ধরে বাংলাদেশিদের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হওয়ার হার বাড়ছে। এতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বিদেশ গমনেচ্ছুসহ ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, বাংলাদেশিদের জন্য মূলত দুই ধরনের ভিসা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর একটি ভ্রমণ ভিসা, অন্যটি কর্মী ভিসা।
বাংলাদেশিদের জন্য বর্তমানে অনেক দেশ ভ্রমণ ভিসা ইস্যু করায় অতিমাত্রায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই শেষে যেসংখ্যক ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে তা-ও নগণ্য।
ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনেক দেশ বর্তমানে ভিসা রেশিও কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রধান কারণ, ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ভিসার আবেদন করা, ভিসা পাওয়ার পর সে দেশে অতিরিক্ত অবস্থান করা এবং তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাওয়া।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ ভ্রমণপিপাসু, শিক্ষার্থী ও বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের ভিসা না পাওয়া নিয়ে একই ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে তাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁদের হতাশাও প্রকাশ করছেন। বিভিন্ন পর্যায়ের এই ব্যক্তিদের হতাশা থেকে জানা যায়, দুই-আড়াই বছর ধরে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা ভিসা পেতে জটিলতায় পড়ছেন। প্রতিদিন বাড়ছে এই জটিলতা।
ট্রাভেল এজেন্সি মালিক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, ‘এটা আসলে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিভিন্ন দেশে গিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করে চাকরি করা—এসব কারণে মূলত ভিসা জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইউরোপের ভিসা আগেও কম দিত। ২০২৪ সালের আগে ইউরোপের ভিসা কিছুটা বাড়লেও পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় তারা ভিসা আবেদন নেওয়াই কমিয়ে দেয়। টুকটাক যা নেয় তারও অন্তত ৮০ শতাংশ বাদ পড়ে যায়। এ ছাড়া এখন তো দিল্লিতে বাংলাদেশের যাত্রীরা যেতে পারছেন না, যার কারণে ইউরোপের দেশগুলোর জন্য আবেদনও করা যাচ্ছে না।’
ভারতের ভিসা বন্ধের প্রভাব ইউরোপে
২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের জন্য ভারত সব ধরনের ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দেয়। বেশ কিছুদিন পর সীমিত আকারে শুধু চিকিৎসা ভিসা চালু করে। এতে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ দেশটিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। ভারতের ভিসা বন্ধের ফলে বাংলাদেশিদের জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গমনে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর কারণ, বাংলাদেশে ইউরোপের অনেক দেশের দূতাবাস নেই। ওই সব দেশের ভিসা দিল্লিতে অবস্থিত দেশগুলোর দূতাবাস থেকে ইস্যু করা হয়। কিন্তু ভারতের ভিসা বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের ইউরোপ গমনেচ্ছুরা দিল্লিতে ওই সব দেশের দূতাবাসে গিয়ে আবেদন করতে পারছেন না। ফলে তাঁরা হতাশার পাশাপাশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
ভিসা সেন্টার পরিবর্তন নিয়েও জটিলতা
ইউরোপের ভিসা জটিলতা নিরসনে গত বছর ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভিসা সেন্টার দিল্লির পরিবর্তে ঢাকা অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তর করা গেলে বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়েই উপকৃত হবে।
এর কিছুদিন পর আয়োজিত আরেক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, বাংলাদেশিদের জন্য বুলগেরিয়া তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে। তিনি অন্য দেশগুলোকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণের আহবান জানান। তবে করোনা মহামারির পর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য ইন্দোনেশিয়ার অন-অ্যারাইভাল ভিসা এবং ঘোষণা ছাড়াই ভিয়েতনামের ভিসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। কিছু কিছু মিশনকে বিকল্প কী করা যায় সে বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিকল্প মানে ভারতের বিকল্প। মিশনগুলোকে বলা হয়েছে, ইউরোপের যে দেশগুলোয় বাংলাদেশের মিশন আছে, ভিসা সেন্টার আছে, সেই দেশগুলোকে বাংলাদেশিদের জন্য ভারত থেকে ভিসা সেন্টার সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করা। কিন্তু তাদের নিজস্ব মতামত রয়েছে। এটা তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে ভারত থেকে তারা সরিয়ে নেবে কি না। আমরা বললেই যে তারা সরিয়ে নেবে তা না। কিন্তু আমরা নিয়ত অনুরোধ করছি।’
অনেক দেশে কর্মী ভিসাও বন্ধ
ভ্রমণ ভিসা নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেলে বাংলাদেশিদের জন্য সে দেশের ভ্রমণ ভিসা সীমিত করে দেওয়া হয়। আবার গত বছর আমিরাতে জুলাই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি বিক্ষোভ করায় সব ধরনের ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দেয় দেশটির সরকার। সেই থেকে অনানুষ্ঠানিক বন্ধ রয়েছে দেশটির শ্রমবাজার। আরব আমিরাত ছাড়াও ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট এক বাংলাদেশির হাতে বাহরাইনে এক ইমাম হত্যাকে কেন্দ্র করে বন্ধ বাহরাইনের শ্রমবাজার। আবার দুর্নীতির অভিযোগে গত বছর ৩১ মে বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এতে বিএমইটির ছাড়পত্র হওয়ার পরও ১৬ হাজার ৯৯০ জন কর্মী দেশটিতে যেতে পারেননি।
এদিকে গত বছর ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ইতালির শ্রমবাজার। ঢাকায় ইতালি দূতাবাস থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে শ্রমবাজার বন্ধের কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, বিপুলসংখ্যক জাল নথি বা ডকুমেন্টের কারণে ইতালি সরকার গত বছর ১১ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের অনুকূলে ইস্যু করা সব কর্ম অনুমোদনের (ওয়ার্ক পারমিট) বৈধতা স্থগিত করেছে, যা যথাযথ যাচাইকরণ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে, যা এখনো বলবৎ আছে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মী ভিসা বন্ধ করে দেয় ওমান। এরপর ২০২৪ সালের জুনে ওমান সরকার জানায়, বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য আরোপ করা ভিসা নিষেধাজ্ঞা থেকে কিছু শ্রেণিকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ফ্যামিলি ভিসা বা উপসাগরীয় দেশগুলোতে বাস করা বাংলাদেশিদের ভ্রমণ ভিসা দেওয়া হবে। চিকিৎসক, নার্স, প্রকৌশলী, শিক্ষক, হিসাবরক্ষক পেশাজীবীরা ওমানের ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ছাড়া লিবিয়া, সুদান, ব্রুনাই, মরিশাস ও ইরাকে কাজের ভিসা এখনো বন্ধ রয়েছে।
তবে পুরোপুরি বন্ধ না হলেও মিসরে অন-অ্যারাইভাল ভিসায় বর্তমানে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার মিসর দূতাবাস থেকে দেওয়া এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ পাওয়ার শর্তগুলো হলো—যাত্রীর পাসপোর্টের মেয়াদ কমপক্ষে ছয় মাস থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, শেনজেনভুক্ত দেশ, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা অথবা নিউজিল্যান্ডের বৈধ ও ব্যবহৃত ভিসা থাকতে হবে।
সূত্র : কালের কন্ঠ