ভারত বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য এবং প্লাস্টিকসহ প্রায় সাত ধরনের পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। ঘোষণার পর রবিবার (১৮ মে) সীমান্তেই অনেক পণ্য আটকে যাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা সমস্যায় পড়েছেন। পাঁচগুণ বেশি খরচ করে আদৌ রপ্তানি করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে, ভারতীয় সরকার বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে নতুন বন্দর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপকে ব্যাপকভাবে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা ঢাকা কর্তৃক ভারতীয় সুতা রপ্তানির জন্য তার স্থলবন্দর বন্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে।
ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শনিবার (১৭ মে) এই নিষেধাজ্ঞার বিস্তারিত জানিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। বিজ্ঞপ্তিটিতে বিশেষভাবে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী, কার্বোনেটেড পানীয়, প্লাস্টিক পণ্য এবং কাঠের আসবাবপত্রের আমদানি সীমিত করার কথা বলা হয়েছে।
বিশেষত, বাংলাদেশ থেকে আসা সব ধরনের তৈরি পোশাক (আরএমজি) শুধুমাত্র নভ শেভা এবং কলকাতা সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমেই আমদানি করা যাবে; এই আমদানির জন্য স্থলবন্দর আর ব্যবহার করা যাবে না।
অন্যান্য পণ্য যেমন প্লাস্টিক, কাঠের আসবাবপত্র, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ফলের স্বাদযুক্ত ও কার্বোনেটেড পানীয়, তুলা এবং তুলার সুতার বর্জ্যকেও আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরামের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য এবং ফুলবাড়ি ও চ্যাংরাবান্ধা সহ পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত পয়েন্টগুলির মাধ্যমে ভারতে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে। তবে মাছ, এলপিজি, ভোজ্য তেল এবং পাথরের কুঁচির মতো পণ্য এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে।
বন্দর নিষেধাজ্ঞা এমন সময়ে এলো যখন বাংলাদেশ ১৩ এপ্রিল, ২০২৫ থেকে ভারতীয় সুতা আমদানির জন্য তার স্থলবন্দর বন্ধ করে দিয়েছে। সুতা, বিশেষ করে রঙিন এবং বিশেষ প্রকারের সুতা, বাংলাদেশে ভারতের বস্ত্র রপ্তানির প্রায় ৩০ শতাংশ। এই বন্ধের কারণে ভারতীয় বস্ত্রকলগুলির সরবরাহ chain ব্যাহত হয়েছে, যার ফলে রপ্তানিকারকরা কন্টেইনার শিপিং এবং অভ্যন্তরীণ জলপথের মতো বিকল্প উপায় খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বলছেন, স্থলবন্দর বন্ধ হলে ভারতে পণ্য রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। কারণ, বিকল্প হিসেবে সমুদ্রপথে খরচ ও সময় দুটোই বাড়বে। সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতের কলকাতা ও মুম্বাই বন্দরে পণ্য খালাস করে স্থলপথে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে হবে। এতে মূল ভূখণ্ডে কিছুটা রপ্তানি হলেও সবচেয়ে বড় বাজার সেভেন সিস্টার্স নামে খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে পণ্য পাঠানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারক জানান, এর আগে তারা সব সময় ভারতের স্থলবন্দর ব্যবহার করেই পণ্য রপ্তানি করেছেন। কখনো সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করেননি। কারণ এতে পরিবহন খরচ প্রায় পাঁচগুণ বেশি হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ওই সব রাজ্যে পণ্য পাঠাতে প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সমুদ্রপথে কলকাতা পণ্য পাঠাতে হবে। পরে পুরো বাংলাদেশের সীমান্ত ঘুরে আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ ও আগরতলায় যাবে পণ্যের চালান।
ড্যানিশ ফুডের হেড অব বিজনেস দেবাশীষ সিংহ উল্লেখ করেন যে তারা ভারতে রপ্তানির জন্য ছয়টি স্থলবন্দর ব্যবহার করেন এবং সবগুলোই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভারত এখন কেবল কলকাতা ও মুম্বাই সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির সুযোগ দিচ্ছে। এই দুটি বন্দর রপ্তানিকারকদের কোনো কাজেই আসবে না, এবং ওইসব বন্দর দিয়ে কোনো রপ্তানিও হয় না।
এতদিন রপ্তানিকারকরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, মৌলভীবাজারের চাতলাপুর, সিলেটের শেওলা, তামাবিল স্থলবন্দরের মতো ছয়টি বন্দর দিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে পণ্য পাঠাতেন। এতে ২০ ফুটের একটি কার্গোর জন্য ভাড়া গুনতে হতো ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকা। যেখানে এখন একই ভাড়ায় চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পণ্য নেওয়া যাবে। এরপর অতিরিক্ত জাহাজ ভাড়া ও কলকাতা থেকে আবারও পণ্য আসাম, মেঘালয়, করিমগঞ্জ বা আগরতলায় নিতে প্রায় এক লাখ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হবে।
বাংলাদেশ প্লাস্টিকপণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি সামিম আহমেদ বলেন, ‘এত খরচ করে সমুদ্রপথে পণ্য নিয়ে সেটা কোনোভাবেই প্রতিযোগিতায় সক্ষম হবে না। আগে কখনো সমুদ্রপথে আমরা পণ্য পাঠাইনি। এখন সেটা করতে হলে আমাদের পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। দেশ থেকে প্রায় ৫০টির বেশি কোম্পানি শুধু প্লাস্টিকপণ্য রপ্তানি করত, সেগুলো একটি বড় বাজার হারাবে।’
আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড ভারতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কোমল পানীয় রপ্তানি করত। প্রতিষ্ঠানটির হেড অব মার্কেটিং মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতের এ সিদ্ধান্তের পর আজ আমরা ভারতের যে অর্ডারগুলো ছিল, সেগুলোর উৎপাদন স্থগিত করেছি। আমরা ভারতে বছরে চার থেকে পাঁচ লাখ কার্টন পণ্য রপ্তানি করতাম। এ সিদ্ধান্তের ফলে আমরা অনিশ্চয়তায় পড়েছি।’
মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, ভারতের ভোক্তারাও কিন্তু স্বল্পমূল্যে ভালো পণ্য থেকে বঞ্চিত হবেন। ফলে আমরা আশা করছি উভয় দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি ভালো সিদ্ধান্ত আসবে শিগগিরই।’
ড্যানিশ ফুডের দেবাশীষ সিংহ বলেন, ‘এখন অন্যভাবে (সমুদ্রপথে) রপ্তানি করার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশি কোম্পানি খরচে পোষাতে পারবে না। কারণ আমরা আগে বর্ডার পার হলেই আসাম, গৌহাটি, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে পণ্য পৌঁছাতে পারতাম স্থলপথে। ওই পথে না গেলে নৌপথে অনেক ঘুরে, বারবার ট্রান্সপোর্ট পরিবর্তন করে খরচে টিকতে পারব না।’
ঢাকা কর্তৃক কূটনৈতিকভাবে বিরোধ মীমাংসার পূর্বের ভারতীয় প্রচেষ্টা সামান্য অগ্রগতি দেখেছে, যার ফলে এই প্রতিশোধমূলক বাণিজ্য সংকোচন ঘটেছে।
উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়ে, ভারত প্রায় পাঁচ বছর আগের একটি ব্যবস্থা বাতিল করেছে যা বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে রপ্তানির জন্য ভারতীয় বিমানবন্দর ও বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিত, এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশের লজিস্টিক সক্ষমতার জন্য একটি আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা আরও জানান, নতুন ব্যবস্থায় সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর বা মোংলা বন্দর থেকে কলকাতার হলদিয়া বন্দরে পাঠাতে হবে। তারপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার্সে যেতে হবে আলাদা পরিবহনের মাধ্যমে। এতে প্রায় সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, যা আগে স্থলবন্দরের মাধ্যমে একদিনেই করা যেত।