যুক্তরাজ্যে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য দীর্ঘদিনের প্রচলিত “স্থায়ী সুরক্ষার” নীতিতে একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন আসছে। অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান মোকাবিলায় লেবার সরকার ডেনমার্কের কঠোর অভিবাসন নীতি অনুসরণ করে এই সংস্কার আনতে চলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ এই পদক্ষেপকে ‘আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় সংস্কার’ বলে অভিহিত করেছেন।
অস্থায়ী মর্যাদা এবং স্থায়ী বসবাসের দীর্ঘ অপেক্ষা
স্থায়ী সুরক্ষার যুগের সমাপ্তি: বর্তমান নীতি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে শরণার্থী মর্যাদা পাওয়া ব্যক্তিরা সাধারণত ৫ বছরের জন্য অনুমতি পান এবং এর পরে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি (Indefinite Leave to Remain – ILR) এবং পরে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন।
অস্থায়ী মর্যাদা: নতুন নীতিতে এই স্থায়ী সুরক্ষার ধারণা বাতিল করা হচ্ছে। এখন থেকে আশ্রয়প্রাপ্তদের প্রাথমিকভাবে ৫ বছরের পরিবর্তে মাত্র আড়াই বছরের (৩০ মাস) জন্য বসবাসের অনুমতি দেওয়া হবে।
নিয়মিত পর্যালোচনা ও ফেরত পাঠানো: এই অস্থায়ী মর্যাদার সময়সীমা নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করা হবে। যদি হোম অফিস মনে করে যে আশ্রয়প্রার্থীর নিজ দেশ এখন ‘নিরাপদ’ বা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, তবে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
স্থায়ী বসবাসের জন্য অপেক্ষা: স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন করার জন্য বর্তমান ৫ বছরের সময়সীমা বাড়িয়ে ২০ বছর করা হবে। অর্থাৎ, একজন শরণার্থীকে স্থায়ী নাগরিকত্বের পথে যাওয়ার আগে দীর্ঘ ২০ বছর অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে।
ডেনমার্কের মডেল কী?
যুক্তরাজ্যের এই নতুন নীতি ডেনমার্কের কঠোর অভিবাসন মডেল দ্বারা সরাসরি অনুপ্রাণিত, যা ইউরোপের অন্যতম কঠোর নীতি হিসেবে পরিচিত। ডেনমার্কে শরণার্থীদের সাধারণত দুই বছরের জন্য অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষে তাদের পুনরায় আবেদন করতে হয় এবং অনুমতি নবায়নের কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। ডেনমার্কের নীতির প্রধান লক্ষ্য হলো, নিজ দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শরণার্থীদের দ্রুত ফেরত পাঠানো। স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পথ অত্যন্ত কঠিন। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পূর্ণকালীন চাকরি, ডেনিশ ভাষা এবং সমাজের সাথে পূর্ণ সংহতি (Integration) সহ বহু কঠিন শর্ত পূরণ করতে হয়। এসব কঠোর নীতির ফলে ডেনমার্কে আশ্রয় আবেদনকারীর সংখ্যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।
সরকারের যুক্তি:
সরকারের বক্তব্য, যুক্তরাজ্যের বর্তমান উদার ব্যবস্থা অবৈধ অভিবাসীদেরকে ইউরোপের নিরাপদ দেশগুলো পাড়ি দিয়ে ছোট নৌকায় করে ব্রিটেনে আসতে উৎসাহিত করছে। নতুন নীতি এই আকর্ষণ কমাবে। কঠোর নীতি গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধ অভিবাসন প্রবাহ এবং ছোট নৌকার সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে। যারা কাজ করতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও কাজ করতে অস্বীকার করবেন বা আইন ভাঙবেন, তাদের জন্য আবাসন ও সাপ্তাহিক ভাতা সহ অন্যান্য সহায়তা তুলে নেওয়া হবে।
সমালোচকদের মত:
মানবাধিকার সংস্থা এবং রিফিউজি কাউন্সিল সহ দাতব্য সংস্থাগুলো এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে। তাদের মতে, এই কঠোর পদক্ষেপ মানুষকে বিপদসংকুল যাত্রা থেকে বিরত করবে না, বরং হাজার হাজার শরণার্থীকে ২০ বছরের দীর্ঘ অনিশ্চয়তা এবং চাপের মধ্যে ফেলে দেবে। সমালোচকদের মতে, অস্থায়ী মর্যাদা এবং প্রত্যাবর্তনের চাপ শরণার্থীদের ব্রিটিশ সমাজে নিজেদের সংহত করতে, ভাষা শিখতে বা কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে বাধা দেবে। এই নীতি ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদের (ECHR) প্রতি যুক্তরাজ্যের অঙ্গীকারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে আগামী সোমবার পার্লামেন্টে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবেন। এই পদক্ষেপ যুক্তরাজ্যে অভিবাসন এবং মানবাধিকারের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।




