২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮ : তিন হত্যাকাণ্ডে শিবিরের উত্থান

প্রগতিশীল আন্দোলন আর সংস্কৃতিচর্চার চারণভূমি হিসেবে পরিচিত সিলেটের বুকে বড় আঘাত এসেছিল ১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও জাসদ ছাত্রলীগের তিন তুখোড় কর্মী মুনির ই কিবরিয়া, তপন জ্যোতি দেব এবং এনামুল হক জুয়েলকে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রগতিবিরোধীরা। সেই হত্যাকাণ্ডের ৩৭ বছর পূর্ণ হলেও আজও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত সেই হত্যাকারীরা। সাক্ষীরা আদালতে না আসায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায় আসামিরা।

জানা যায়, সিলেটের ছাত্র রাজনীতির মাঠে তখন বাম ধারার ছাত্র সংগঠন, বিশেষ করে জাসদ ছাত্রলীগসহ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অবস্থান ছিল অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর থেকে বেশি শক্তিশালী। শিবির সিলেটে প্রকাশ্যে তাদের রাজনীতি শুরু করতে গেলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তৎপরতার কারণে সাফল্য পায়নি। সিলেটের প্রগতিশীল ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে শিবির ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারছিল না। সিলেটকে তারা কয়েকটি এলাকায় ভাগ করে শুরু করে এলাকাভিত্তিক রাজনীতি। আলিয়া মাদ্রাসার মধ্যে অন্য কোনও প্রগতিশীল সংগঠনের কার্যক্রম না থাকায় তারা মাদ্রাসা ক্যাম্পাস দখলে নেয়। শিবিরকে প্রতিরোধ করার জন্য বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সিলেটে গঠন করা হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে তখন ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাতীয় ছাত্রদল ও জাতীয় ছাত্রলীগ।

এসব ছাত্র সংগঠনের তৎপরতায় শিবিরের রাজপথ দখলের পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে লাগলে প্রগতিবিরোধী এই সংগঠনটি অন্য পথ ধরে। একই দিনে তারা হত্যা করে জাসদ ছাত্রলীগের মুনির, তপন ও জুয়েলকে।

তৎকালীন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় অনেকের দেয়া তথ্যমতে, ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরগরম হয়ে ওঠে সিলেটের ছাত্র রাজনীতি। বিপুল অর্থ ব্যয় করে শিবির পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নিজেদের প্যানেলের পক্ষে প্রচারণার মাধ্যমে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করে। নির্বাচন নিয়ে যখন দক্ষিণ সুরমায় উত্তেজনা বিরাজ করছে, সেই সময়ে এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর হামলা চালায় শিবির। তারা সিলেটে সশস্ত্র মিছিল বের করে। সেপ্টেম্বরের ১৯ ও ২০ তারিখেও শিবির এমসি কলেজে সশস্ত্র অবস্থান নেয় এবং ছাত্রলীগকে তারা কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়নি। ২০ সেপ্টেম্বর ছিল সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র সংসদের নির্বাচন। নির্বাচনে শিবিরের ব্যাপক ভরাডুবি হয় এবং সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্র সংসদের ১৫টি পদের সবগুলোতে জয়লাভ করে।

১৯৮৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে শিবিরকর্মীরা এমসি কলেজ ক্যাম্পাস দখল করে নেয়। এছাড়া সিলেট আলিয়া মাদ্রাসাকে নিজেদের হেডকোয়ার্টার বানিয়ে শিবির নগরীর বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি, মোটরসাইকেল ও টেম্পোযোগে সশস্ত্র মহড়া দিতে শুরু করে।

শিবিরের এই আকস্মিক ক্যাম্পাস দখলের ফলে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তারা কলেজের আশপাশে অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। তখন আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টেম্পোযোগে একদল সশস্ত্র কর্মী নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় জড়ো হওয়া জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর চারপাশ থেকে সশস্ত্র হামলা চালায়। মুনিরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে কোপাতে তারা রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। পাথর দিয়ে তপনের শরীর থেঁতলে দেয়। একই সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এমসি কলেজে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। শিবিরের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে আম্বরখানায় স্কুলছাত্র এনামুল হক জুয়েলকে ধাওয়া করা হয়। জুয়েলের জন্য শিবির স্কুলগুলোতে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারছিল না বলে তার ওপর তাদের ক্ষোভ ছিল। অস্ত্রধারী শিবির ক্যাডারদের ধাওয়া খেয়ে জুয়েল তখন দৌড়ে একটা মার্কেটের ছাদে উঠে যায়। অস্ত্র নিয়ে তার পেছনে পেছনে ধাওয়া করতে থাকে শিবিরের সন্ত্রাসীরা। শিবিরের ধাওয়া খেয়ে নিরুপায় জুয়েল কোনও রাস্তা না পেয়ে মার্কেটের এক ছাদ থেকে পার্শ্ববর্তী ছাদে লাফ দিতে গিয়ে নিচে পড়ে যান এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।

মুনির, তপন ও জুয়েল হত্যাকাণ্ডের পর জাসদ নেতা ছদরউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে মুনির, তপন, জুয়েল হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে তৎকালীন শিবিরের নেতা জিয়াউদ্দিন নাদের, সায়েফ আহমদ, সোহেল আহমদ চৌধুরী, জিয়াউল ইসলাম, আবদুল করিম জলিল এবং অজ্ঞাত বেশ কয়েকজনের নামে মামলা করেন।

মুনির ও তপন হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শামীম সিদ্দিকী, কামকামুর রাজ্জাক রুনু ও বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী। মামলা চলাকালীন তারা কেউই আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে এসে সাক্ষী দেননি। যার কারণে তারা মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

অভিযোগ আছে, এই মামলায় কামকামুর রাজ্জাক রুনুর সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণ হলো মামলার অন্যতম আসামি সুহেল আহমদ চৌধুরী তার আত্মীয় ছিল। মামলার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী বিষ্ণুপদ চক্রবর্ত্তী মামলা চলাকালীন সিলেট ছেড়ে চলে যান এবং মামলা শেষ হওয়ার আগে আর সিলেটে আসেননি। সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় মামলার আসামিরা সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। ২৯ বছরেও আর তাই ‍মুনির-তপন-জুয়েলের হত্যাকারীরা থেকে গেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025