তারেকের নিজ দেশে ফেরায় বাধা কোথায়

গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। কিন্তু তাদের অপেক্ষার প্রহর আজও ফুরায়নি। তারেক রহমান কবে ফিরবেন, এই প্রশ্নে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জবাব আওয়ামী লীগ শাসনামলের বক্তব্য থেকে আলাদা কিছু নয়

রাজনৈতিক অঙ্গনে যে প্রশ্নটি গত ৯ মাস ধরেই ফিসফাস করে বলা হচ্ছিল, তা এখন বলতে শুরু করেছেন বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর নেতারাই। প্রশ্নটি হলো, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান কেন ফিরছেন না? নাকি তার ফিরতে কোনো বাধা আছে?

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৯ মাসে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় সব সাজা আর মামলা বাতিল হয়ে গেছে। তবে কেবল ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের একটি মামলা আছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান অবশ্য বলেছেন, “ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে না ফেরায় দলীয় কার্যক্রমের কোনো ব্যাঘাত ঘটছে বলে আমার মনে হয় না। বরঞ্চ, লন্ডন থেকে তিনি স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন। তার পরামর্শেই দল জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।”

নেতাকর্মীদের হতাশ না হয়ে গণতন্ত্রের পথে এগুনোর আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে, তারেক কবে ফিরবেন— এমন প্রশ্নে অসংখ্য প্রতিবেদন এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। কোনোটিতে বলা হয়েছে ‘যে কোনো সময়’, কোনোটিতে বলা হয়েছে ‘২০২৪ সালের ডিসেম্বর’, কোনোটিতে ‘নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি’, কখনও লেখা হয়েছে ‘মার্চ’, কখনও লেখা হয়েছে ‘এপ্রিল’। তবে মে মাসে ফিরবেন, এমন শিরোনামে সংবাদ আর আসেনি।

গত ৬ মে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার দুই পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফেরার আগে তাদেরকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে বিদায় জানান তারেক রহমান। সেদিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেনের কাছে সংবাদকর্মীরা জানতে চান— খালেদা জিয়া ফিরেছেন, তারেক কবে ফিরবেন?

জবাব আসে, “আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যাতে করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশে ফিরে জাতির নেতৃত্বে যোগ দিতে পারেন।”

ইদানীং বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতারা সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখছেন— তারেক রহমানের ফেরায় কোনো বাধা আছে কি না।

গত ১০ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “এখন সরকারের কাছ থেকে আমরা জানতে চাই, তারেক রহমানের দেশে ফেরার পেছনে কোনো বাধা নেই। আপনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফিরতে কোনো বাধা নেই।”

এমন কথা কেন বলেছেন- এই প্রশ্নে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই নেতা বলেন, “আমরা তো এই সরকারের কাছে জানতে প্রশ্ন রেখেছি। তারা বলুক, বলুক যে আমাদের নেতার ফেরায় কোনো বাধা নেই। তাহলেই সব বেরিয়ে আসবে।”

আপনারা কি মনে করছেন কোনো বাধা আছে- এমন প্রশ্নে গয়েশ্বর বলেন, “সেটাই তো বলবে এই সরকার। বলুক, বাধা নেই। আমিও এই উত্তর জানতে চাই। তারা উত্তর দিলেই তো সব পক্ষের জল্পনা শেষ হবে।”

৯ দিন পর জাতীয় প্রেস ক্লাবেই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করা ১২ দলীয় জোটের নেতারাও একই প্রশ্ন রাখেন।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, “জাতি জানতে চায় তারেক রহমানের দেশে ফিরতে প্রতিবন্ধকতা কোথায়?”

জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোট প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, “তার দেশে ফিরতে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা আপনারা স্পষ্ট করেন। এটা ইউনূস সরকারকেই স্পষ্ট করতে হবে।”

বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, “তারেক রহমানকে দেশে ফেরার নিশ্চয়তা দিন। কিন্তু আপনারা কোনো কথা বলেননি।”

কেন ফিরছেন না?

বিএনপি নেতারা বলছেন—তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী, তার নিরাপত্তার বিষয়টি কী হবে, পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী দেশগুলোর মনোভাবও তারা বুঝতে চেষ্টা করছেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশকাল নিউজ ডটকমকে বলেন, “নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেই সিদ্ধান্ত নিবেন কবে ফিরবেন।”

ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, “আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ফেরার পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি করতে পারিনি আমরা।”

‘প্রভাবশালী দেশগুলো’ থেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই— মন্তব্য করে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “অনেক জটিল কিছু নেই এখানে। আইনি লড়াই শেষ হলেই তিনি ফিরবেন, আর তা খুব শিগগিরই।”

বিএনপির প্রবীণ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আইনি জটিলতার পাশাপাশি দেশের সর্বোচ্চ শক্তিধারী এক মহলের সিদ্ধান্তের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হচ্ছে বলেও আমার ধারণা।”

তবে সেই ‘সর্বোচ্চ শক্তিধারী’ মহল কারা—সেই প্রশ্ন খোলাসা না করে তিনি বুঝে নিতে বললেন।

মামলার জটিলতা এখনও আছে?

আওয়ামী লীগ শাসনামলে তারেক রহমান যেসব মামলায় সাজা পেয়েছিলেন, তার কোনোটিতে আপিল না করেই তিনি মুক্ত হয়ে গেছেন। উচ্চ আদালতে একতরফা শুনানি শেষে এসব আদেশ এসেছে।

যেসব মামলা চলছিল, তার মধ্যে একটি ছাড়া বাকি সবগুলো বাতিল হয়ে গেছে।

তারেকের মামলার খোঁজ খবর রাখতেন দলের এমন আইনজীবী নেতারা জানান—২০০৭–০৮ সালের সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরে আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে ৮৪ অথবা ৮৫টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৭টি করা হয় ২০০৭ সালে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি, অবৈধ সম্পত্তির অর্জন, সিঙ্গাপুরে অর্থপাচার, শেখ মুজিবুর রহমানকে কটূক্তি ও রাষ্ট্রদ্রোহ—মোট ছয়টি মামলায় সাজা ঘোষণা হয়েছিল।

আপিল বিভাগ সব সাজা বাতিল করেছে গত ৯ মাসে।

তারেকের আইনজীবী জাকির হোসেন জানান, বিভিন্ন জেলায় করা নাশকতা, চাঁদাবাজি এবং মানহানির মামলা হাইকোর্ট খারিজ অথবা স্থগিত করেছে।

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক সাব্বির হত্যা মামলার আসামি সাফিয়াত সোবাহান সানভীরকে দায়মুক্তি দিতে ২১ কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের মামলাতেও তারেক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান খালাস পেয়েছেন।

তবে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান, তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান এবং শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলাটির সাজা এখনও রয়ে গেছে।

২০২৩ সালের ২ আগস্ট এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছর এবং জুবাইদা রহমানকে ৩ বছরের সাজা হয়। ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জুবাইদার সাজা এক বছরের জন্য স্থগিত হয়, তবে তারেকের সাজা এখনও বহাল।

বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, “মামলাটিতে মাত্র ৯ দিন শুনানি করে সাজা দেওয়া হয়েছিল, ৫৬ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। মামলাটিতে রাতের অন্ধকারে এমনকি মোমবাতি জ্বালিয়েও সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। আমরা সব সময় যে কথা বলে আসছি—দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং জুবাইদা রহমান ম্যাডামসহ যারা আছেন, প্রত্যেকটা মামলায় জিয়া পরিবার আইনের শাসনের প্রতি বিশ্বাসী। দেশের প্রচলিত সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসী এবং আদালতের প্রতি আস্থাশীল। ওনাদের মামলাগুলো ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে নিষ্পত্তি হবে।”

তাহলে তারেক কি এই মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়- এই প্রশ্নে কায়সার কামাল বলেন, “দেশে আসার ব্যাপারে তিনি নিজেই যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।”

দীর্ঘ লন্ডনবাস

সেনা-নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তারেক রহমান। ওই সরকারের আমলে তিনি ১৮ মাস কারাগারে ছিলেন।

বিএনপির পক্ষ থেকে বন্দি অবস্থায় নির্যাতনের অভিযোগও আনা হয়। বিএনপি ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তারেক।

১১ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবারকে নিয়ে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে বাংলাদেশ ছাড়েন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে।

দেশ ছাড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতি থেকে পাঁচ বছর দূরে থাকার বিষয়ে একটি চিরকুট সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হয়েছিল। তবে পরে বিএনপি এটি অস্বীকার করে। সে সময় বিএনপিতে তারেক রহমানের পদ ছিল জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বরের জাতীয় সম্মেলনের পর তাকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ৫ বছরের সাজা নিয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তাকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়।

এ জন্য দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনও করে বিএনপি। এর আগে ছিল সাজাপ্রাপ্ত কেউ দলের নেতৃত্বে আসতে পারবেন না।

যে মামলায় সাজা খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছিল, সেই মামলায় তারেকের সাজা হয় ১০ বছর। এর আগে বিদেশে অর্থপাচার মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২০ কোটি টাকা জরিমানার আদেশ আসে।

খালেদা জিয়া মুক্ত হওয়ার পরেও তারেক রহমানই কার্যত এখন দল চালাচ্ছেন।

Tags :

Staff Reporter

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025, Jun 16