গত শুত্রবার লন্ডনে মুহাম্মদন ইউনূস-তারেক রহমানের দুঘন্টা কথা হয়েছে, যার মধ্যে আধা ঘন্টা বৈঠকের আয়োজন ও কুশল বিনিময়। তা বাদে দেড় ঘন্টা তাদের মধ্যে একান্তে বৈঠক হয়েছে, যার বিবরণ মিডিয়ায় আসেনি।
বাংলাদেশের মিডিয়া নিজেদেরে মত করে যার যার মত সংবাদ ছেপেছেন। ওই দেড় ঘন্টা যে লন্ডনের আবহাওয়া, প্রফেসর সাহেবের বয়স কিংবা তারেকের স্বাস্থ নিয়ে কথা হয়নি সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাহলে কী আলোচনা হতে পারে ওই গোপন বৈঠকে? নিশ্চয়ই এমন কিছু যা টপ সিক্রেট। যা এমনকি নিজ নিজ সফরসঙ্গীদেরও বলা যায় না। নির্বাচনের তারিখ আগুপিছু করা? তার জন্য ৩৭ জনের লটবহর নিয়ে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ করে লন্ডনে যাবার দরকার করে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন, আসন ভাগ-বাটোয়ারা এসব কমন বিষয়ে আলোচনা হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই এই আলাপ-আলোচনাটা একান্তই নিজেদের মধ্যে হয়, কিংবা কোনওভাবে যেন সেই আলোচনার বিষয়বস্তু বাইরে না যায়, তখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে দুজনের মধ্যে এমন কোনও সমঝোতা হয়েছে যা প্রকাশিত হলে দুজনেরই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা বোঝাপড়া জনসমক্ষে এসে বিব্রতকর অবস্থা হবে। এমনকি ইউনূসের ‘সুপার চিফ অ্যাডভাইজার’ সফিকুর রহমানও এই বৈঠকে কল্কে পায়নি।
আদপে দুজনের কেউ চাননি ওই আলোচনার বিষয়বস্তু জনসমক্ষে আসুক। তাতে করে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তো কী কী সমঝোতা হতে পারে ওই একান্ত গোপন বৈঠকে সেটি অনুমান করা যাকঃ
১। বিএনপি ইউনূসবিরোধী, করিডোরবিরোধী, খলিলুরবিরোধী, নিউমুরিং জেটি লিজের বিরোধী এবং আমেরিকাবিরোধী একটা অবস্থান নিয়েছিল। ইউনূসের পক্ষ থেকে একটা টোপ দিতেই সব বিরোধীতা শেষ। সেইসঙ্গে আর্থিক লেনদেনের টোপও দেওয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে নিউমুরিং জেটে লিজের একটা বড়সড় বখরা তারেক রহমানের জন্য থাকবে। সুতরাং তারেকের সিদ্ধান্ত বদল করতে সমস্যা হয়নি।
২। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা নিয়ে বিএনপি যে গোঁ ধরেছিল তার সাথে মিলে গিয়েছিল সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের আল্টিমেটাম। এই ইস্যুতে দুটি পক্ষ কাছাকাছি আসছিল, যা ইউনূসের জন্য অস্বস্তিকর। ইউনূসের দুচোখের বিষ ওয়াকার। আবার ওয়াকারের ভাষ্যমতে ইউনূস ‘কনভিক্টেড’। তাই দরকষাকষির মত হয়েছে- আপনি তারিখটা এগিয়ে আসুন, আমিও পিছিয়ে আনি। এই ফর্মূলায় এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারিতে সাব্যস্ত করে বিএনপি-ওয়াকার কাছাকাছি হওয়ার সম্ভবনাকে মেরে দিয়ে ভোট এগিয়ে আনার মূলো ঝুলিয়ে দিলেন বিএনপির সামনে। এতে করে যে ওয়াকার ক্ষেপে গেলেন সেটা তারেকের অপরিপক্ক মাথায় ঢুকল না।
৩। আওয়ামী লীগকে নিয়ে বিএনপি বিভিন্ন সময়ে স্ববিরোধী কথা বলেছে। কখনও বলেছে-‘আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করতে দেয়া-না দেয়ার মালিক জনগণ, আর কেউ নয়’। আবার স্বয়ং ইউনূসও বলেছেন-‘বিএনপি যদি চায় তাহলে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতেই পারে।‘ এবার ইউনূস তারেককে বোঝালেন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে থাকলে বিএনপি দ্বিতীয় নয়, তৃতীয় স্থানে নেমে যেতে পারে। তাতে করে তারেকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েশ পানিতে পড়বে। সুতরাং আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখেই নির্বাচন করতে হবে। তাতে করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ভোট বিএনপির ঝুলিতেও আসবে। তারেক দেখলেন মোক্ষম লজিক তো! তারেক সাহেব সানন্দে রাজি হলেন। তারেক বুঝতেই পারছেন না আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচন হলে জামাত এক নম্বরে চলে আসবে। ইউনূসও তাই চান কারণ, তিনি র্যাডিক্যাল ইসলামিস্টদের পাকাপোক্ত অবস্থান করে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
৪। জুলাই ঘোষণাপত্র। এতে এমন কিছু বিষয় থাকবে যা বিএনপি এতদিন বিরোধীতা করে আসছিল। এখনও করছে। সেটা যেন বিএনপি না করে। তারেকের কাছ থেকে ‘বিএনপি জুলাই ঘোষণাপত্রের বিরোধীতা করবে না’ সেই নিশ্চয়তা আদায় করে নিলেন ইউনূস।
৫। খলিলুর রহমানের বিরোধীতাকারী বিএনপি যেন খলিলুর রহমানের নারী ঘটিত কেলেঙ্কারী নিয়ে ভবিষ্যতে উচ্চবাচ্য না করে। খলিলসহ বাকি দুজন উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবী থেকে যেন সরে আসে সেই প্রতিশ্রুতিও আদায় করতে পারেন ইউনূস। সে কারণেই হয়ত ইউনূস সাহেব খলিলুর রহমানকে দিয়ে তারেককে অভ্যর্থনা জানানো এবং সারাক্ষণ আশেপাশে ঘুরঘুর করিয়েছেন। ভাবি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রলোভনে তারেক খলিলুর রহমানকে শত্রু থেকে বন্ধুতে উন্নিত করলেন।
৬। বিএনপি সরকার গঠন করার পর ইউনূসের ৬৬৬ কোটি টাকা কর ফাঁকির রায় বাতিলের ব্যাপারটা যেন আবার তাজা না করে। গ্রামীণ ব্যাংকের ৫ বছর কর রেয়াত, ইউনূসের একাধিক ব্যবসায়ীক লাইসেন্সসহ ৫ আগস্ট থেকে বিএনপির সরকার গঠনের কাল পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সকল কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিয়ে আবার যেন নতুন করে মামলাটামলা রুজু না করে সেই প্রতিশ্রুতিও হয়ত আদায় করে নিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
৭। তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ও আলোচনা হয়েছে নিশ্চয়ই। ইতোমধ্যে আদালত তারেক রহমানের সকল মামলা স্থগিত/প্রত্যাহার করেছে সেটা তারেক রহমানও জানেন। কিন্তু এটা হয়ত জানেন না যে ইউনূস দেশ ছাড়ার আগে তার সরকার তারেকের বিরুদ্ধে মামলাগুলো স্থগিত করার বিরুদ্ধে আপিল করেছে এবং তা আদালতে গৃহিতও হয়েছে। এখন বিএনপির সঙ্গে সবকিছু মিটমাট হওয়ার পর মনে করা হচ্ছে সেই আপিল তুলে নেবে সরকার। আসলে কি তুলে নেবেন?
ইউনূস সাহেব অনেক বড় মাঠের খেলোয়াড়। তিনি হাতের পাঁচ না রেখে কারও সাথে ‘ডিল’ করবেন সেটা কখনোই হতে পারে না। হতে পারে তারেক বা বিএনপি একটু বেগড়বাই করলেই ইউনূস তারেকের মামলাগুলো তেল-মোবিল দিয়ে সচল করে দেবেন।
এই সাতটি পয়েন্টের বাইরেও আরেকটি বড় ধরণের অভিঘাত আছে। সেটা জেনারেল ওয়াকারকে নিয়ে। এই বৈঠকে বিএনপি এবং ইউনূস সমঝোতায় এসে কার্যত জেনারেল ওয়াকারের ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে’ আল্টিমেটামের ওপর সজোরে চপেটাঘাত করেছেন। ওয়াকার ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন দেড় ঘন্টা ধরে ইউনূস-তারেক নিশ্চয়ই নির্বাচন দুমাস এগিয়ে আনার বিষয়েই শুধু কথা বলেননি।
সেনাপ্রান আরও জানেন মধ্য ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। যৌথ বিবৃতির ভাষায় এমন কিছু মারপ্যাঁচ আছে যার মীমাংসাও হবে না। নির্বাচন হওয়ার সম্ভবনা শূন্য। যৌথ বিবৃতির চুম্বক অংশে বলা হয়েছে-“সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন কমিশনের সংস্কার সম্পন্ন করা গেলে রমজানের আগেও নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যেতে পারে।“
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন প্রশাসনিক ভাষায় ‘করা যেতে পারে’ মানে করা নাও হতে পারে। সে সময় নির্বাচন পেছানোর জন্য ইউনূসের হাতে থাকবে “বিচার ও সংস্কারের প্রয়োজনীয় অগ্রগতি না হওয়া”। বিচার মানে তো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিচার। গত দশ মাসে যেখানে একটা মামলারও চার্জশিট দিতে পারেনি, সেখানে হাজার হাজার নেতা-কর্মীর চার্জশিট, সওয়াল জবাব, বিচার সমাপ্তকরণ, রায় প্রদান, রায় বাস্তবায়ন, অভিযুক্তদের দেশে ফিরিয়ে আনার কাজগুলো কি কয়েক মাসে হবে? নাকি হতে পারে?
তাহলে বিকল্প কি? সিম্পল। প্রয়োজনীয় সংস্কার, বিচার না হলে তা সে ফেব্রুয়ারি বা এপ্রিল যখনই হোক নির্বাচন হচ্ছে না। তখন তারেক রহমান সাহেব কীভাবে প্রধানমন্ত্রী হবেন? সেটাও ভেরি সিম্পল। জুলাই ঘোষণা বলবত হলেই বর্তমান সংবিধান ‘এক দলা কাগজ’ হয়ে যাবে। ওই ঘোষণাই তখন সংবিধান। তার বলে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, জেনারেল ওয়াকারকে পদচ্যুত করা হতে পারে। জাতীয় সরকার গঠিত করে মুহাম্মদ ইউনূস প্রেসিডেন্ট, তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং জামাত-বিএনপি- এনসিপি-হেফাজত ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটি মহা জাতীয় সরকারের মন্ত্রীসভা গঠিত হবে। তখন আর কারও স্বপ্নেও নির্বাচন বিষয়টি চাগাড় দিয়ে উঠবে না। ইটস আর ভেরী ভেরী ওয়লপ্রোটেক্টেড মেটিক্যুলাসলি ডিজাইনড প্ল্যান।
এই সমস্ত ওয়াটাররগেট কিংবা কন্ট্রা ষড়যন্ত্রেরর প্রপিতামহ ষড়যন্ত্র; ইউনূস-তারেক মেটিক্যুলাস প্ল্যানের সাজানো বাগানকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে পারে সেই ব্যক্তিটি যাকে এই দুজনই প্রবল অহমিকায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য অবহেলায় অবজ্ঞা করে আসছেন….সেই জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। আবার এমনও হতে পারে স্বয়ং তিনও এই প্ল্যানের অংশ?! হতে পারে না? হতেই পারে। তাহলে? আম-দুধ-নুন-চিনি সব একাকার হয়ে যাবে এবং আঁটির (জনসাধারণ) গন্তব্য হবে বাড়ির পেছনের কাচড়া ডোবা-নালা।
মনজুরুল হক
১৬ জুন ২০২৫