তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভয়াবহ অবস্থানে বাংলাদেশ

বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয়, যা এখন আর শুধু পরিবেশ নয় বরং স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। মঙ্গলবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে তাপের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দুর রহমান। অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার মিস ইফফাত মাহমুদ ও সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ওয়ামেক এ. রাজা মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

তারা জানান, ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ‘অনুভূত তাপমাত্রা’ বেড়েছে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার মতে, ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে গরম ৯টি বছর। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল রাজধানী ঢাকায়। ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সময়ে ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ন, গাছপালা উজাড় ও কংক্রিট-নির্ভর উন্নয়নে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ তাপ।

গরমে বাড়ছে রোগব্যাধি, স্বাস্থ্যঝুঁকি

বিশ্ব ব্যাংকের ২০২৪ সালের একটি জরিপে উঠে এসেছে কিছু ভয়াবহ তথ্য। এতে দেখা গেছে, তাপমাত্রা বাড়লেই বাড়ছে শারীরিক ও মানসিক রোগের প্রকোপ। যেমন, দীর্ঘমেয়াদি কাশি। শীতে আক্রান্ত ৩.৩ শতাংশ, গ্রীষ্মে এই রোগ বেড়ে যায় ৬ শতাংশে। ‍‍‌‍৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ঝুঁকি ২২.৭ শতাংশ বেশি।

এছাড়া গরমের সময় তাপজনিত ক্লান্তিতে কর্মক্ষম মানুষ ও প্রবীণরা বেশি ভোগেন। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ঝুঁকি ২৬.৫ শতাংশ বেশি। গ্রীষ্মে ডায়েরিয়ায় আক্রান্তের হার ৪.৪ শতাংশ, যা শীতে ১.৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন নারী ও ৫ বছরের নিচের শিশু। ‍৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় ঝুঁকি ৪৭.৭ শতাংশ বেশি থাকে।

মানসিক স্বাস্থ্য

বিষণ্নতা গ্রীষ্মে দেখা যায় ২০ শতাংশ, শীতে ১৬.২ শতাংশ। উদ্বেগ বাড়ে গ্রীষ্মে ১০ শতাংশ, শীতে ৮.৩ শতাংশ। ‍‍৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় বিষণ্নতা ২৩.৮ শতাংশ এবং উদ্বেগ ৩৭.১ শতাংশ বেড়ে যায়।

গরমে কমছে কর্মক্ষমতা, বাড়ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি

গবেষণায় দেখা গেছে, তীব্র গরমে শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনীতির জন্যও ভয়ঙ্কর ধাক্কা। ২০২৪ সালে ২১ হাজার কোটি টাকার মতো কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে যার আর্থিক ক্ষতি ১.৩৩ থেকে ১.৭৮ বিলিয়ন ডলার। এটি জিডিপির ০.৩ থেকে ০.৪ শতাংশ ক্ষতি। ‍‌‍‌‍‍‍‌২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষতি বেড়ে হতে পারে জিডিপির ৪.৯ শতাংশ। ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা ছাড়ালেই শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদনশীলতা হঠাৎ কমে যায়।

সুপারিশ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ। এগুলো হলো-
১. জাতীয় প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে। তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় নিতে হবে সমন্বিত ও দ্রুত ব্যবস্থা।
২. স্বাস্থ্যখাত প্রস্তুত করতে হবে। হাসপাতাল ও জরুরি সেবায় গরম-সম্পর্কিত বিশেষায়িত ব্যবস্থা প্রয়োজন।
৩. প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। গরমে সহনশীল আবাসন, ঠান্ডা রাখার প্রযুক্তি, ছায়াযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে।
৪. আবহাওয়া তথ্য ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপ নিতে হবে। সময়মতো সতর্কতা ও পরিকল্পনার জন্য নির্ভরযোগ্য ও বিস্তারিত আবহাওয়া তথ্য জরুরি।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন দরকার। জলবায়ু অভিযোজনের জন্য বৈশ্বিক ফান্ড ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন।

শুধু বাংলাদেশ নয়, তাপপ্রবাহ এখন একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট। তবে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। নগর পরিকল্পনা, সবুজায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও নীতিনির্ধারণ- সবক্ষেত্রেই ‘তাপ-সচেতনতা’ আনতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা থাকলে বাংলাদেশও এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025