দক্ষিণ এশিয়ায় একদিকে চলছে বাণিজ্যযুদ্ধ, অপরদিকে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। দুইয়ে মিলে এখন টালমাটাল মহাদেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে বাংলাদেশ হয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে নেপাল পর্যন্ত। রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলতে গেলে আলোচনায় আসবে পুরো এশিয়ারই কথা। তবে এসব অস্থিরতার পেছনের কারণ ভিন্ন হলেও আন্দোলনের প্যাটার্নে মিল দেখা গেছে। শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে শুরু করে নেপালের পার্লামেন্টে দেখা গেছে উত্তেজিত মানুষের রোষানল। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়—পুরো এশিয়ার বেশ কিছু দেশেও চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।
একসময় শ্রীলঙ্কার ‘নায়ক’ হিসেবে পরিচিত রাজা পাকসে ২০২২ সালের ৯ মে বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ রূপ নেয় এক অগ্নিগর্ভে। দিনের পর দিন জমতে থাকা ঋণের বোঝা, আর মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত জনজীবনে জন্ম নেওয়া এক স্ফুলিঙ্গ থেকে পতন ঘটে সরকারের। বিক্ষোভে উত্তাল হয় শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারপন্থিদের সংঘর্ষ হয়, এতে অনেক হতাহত হয়। উত্তাল কলম্বোতে কারফিউ জারি করা হয়। কারফিউর মধ্যেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন রাজা পাকসে। পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে দেশ ছাড়ার খবরে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ঢুকে পড়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। নজিরবিহীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকট ও বিক্ষোভের মধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহে। রাজা পাকসে জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগেই গিয়ে আশ্রয় নেন মালদ্বীপে। বিক্ষোভকারীরা নিরাপত্তা ভেঙে প্রবেশ করেন রাজা পাকসের বাসভবনে। সেখানে উল্লাস করতে দেখা যায় বিক্ষোভকারীদের।
২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরির নিয়োগ ব্যবস্থায় কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের মাঝেই উচ্চ আদালতের রায়কে ঘিরে শুরু হয় তীব্র অসন্তোষ। এরপর জুলাই মাসে সেই আন্দোলন তীব্র গণআন্দোলনে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীদের দমন নিপীড়নের কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন দাঁড়ায় সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে। বিক্ষোভের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আশ্রয় নেন ভারতে। শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এবং সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রবেশ করেন বিক্ষোভকারীরা। প্রধানমন্ত্রী দেশ ছাড়ার খবরে তাদেরও উল্লাস করতে দেখা যায়।
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ ঘোষণা করায় এবং সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফুঁসেছে সে দেশের তরুণরা। বাংলাদেশের আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখা প্রজন্ম জেন জি এবার আন্দোলনে নেমেছে নেপালে। সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) কাঠমুন্ডুতে বিক্ষোভে নামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা পেরিয়ে পার্লামেন্ট প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েন তারা। তখন বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান, রাবার বুলেট ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের দমাতে তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এরপর কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
কারফিউ উপেক্ষা করে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) দ্বিতীয় দিনের মতো কাঠমান্ডুর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করছেন তরুণরা। এ সময় জেন-জি বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেপালি কংগ্রেস পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন। কয়েকটি বাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দিয়েছেন।
নেপালে সহিংস দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভে উত্তেজনা বাড়ায় পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা অলি। শত শত বিক্ষোভকারী তার দফতরে প্রবেশ করার পর মঙ্গলবার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নেপালের বিমানবন্দর।
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি জটিল ও পরিবর্তনশীল অঞ্চল এবং বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ সংঘাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা। দেশভেদে অস্থিরতার কারণ ভিন্ন হয়। যেমন- আফগানিস্তানে দীর্ঘদিনের সংঘাত, পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভারতে এবং বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট।
শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা গেছে— দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে। ফিলিপাইনের রাষ্ট্রপতি ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা দুতার্তের মধ্যে একটি মারাত্মক ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছিল। সারার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং সামরিক অভ্যুত্থানের হুমকির অভিযোগ ছিল। নিজের উপর হুমকি আসায় তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র, তার স্ত্রী এবং পার্লামেন্টের স্পিকারকে খুন করতে একজন গুপ্তঘাতক ঠিক করে রেখেছেন এবং তাকে হত্যা করা হলে এদের কেউ বাঁচবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন। প্রেসিডেন্ট মার্কোস জুনিয়র ফিলিপাইনের সাবেক স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে। ২০ বছর ক্ষমতা দখল করে রাখা ফার্দিনান্দকে ১৯৮৬ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়। এদিকে সারা দুতার্তে ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের মেয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর তাকে গ্রেফতার করে সেদেশের পুলিশ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের প্রতিনিধি পরিষদের আইনপ্রণেতারা সারাকে অভিশংসনের সিদ্ধান্ত নেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় হঠাৎ সরকারবিরোধী তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের ভেতরেও সংসদ সদস্যদের জন্য বিশাল অঙ্কের মাসিক ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণাই আন্দোলনের সূচনা করে। পরবর্তীকালে পুলিশের গাড়িচাপায় এক তরুণ ফুড ডেলিভারি কর্মীর মৃত্যুই বিক্ষোভকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। গত মাসে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের ঘটনায় এখনও প্রায় ৬০০ জন আটক রয়েছে বলে জানিয়েছে সেদেশের পুলিশ।
থাইল্যান্ডে দুই বছরের মধ্যে তিনবার প্রধানমন্ত্রী বদল হয়েছে। সম্প্রতি কয়েক বছরে থাইল্যান্ডে একের পর এক আদালতের রায় কিংবা সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে সরকার। গত সপ্তাহে সাংবিধানিক আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রী পায়েতংতার্ন সিনাওয়াত্রা পদচ্যুত হন। তারই স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ব্যবসায়ী অনুতিন চার্নভিরাকুল।
অপরদিকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর দলের ভেতর-বাইরে চাপের মুখে পড়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু। ক্ষমতা গ্রহণের ১১ মাসের মাথায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন ইশিবা। দেশটি বর্তমানে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ গাড়িশিল্পের ওপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব নিয়ে চাপে আছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিতিশীলতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। আফগানিস্তান ও নেপালের মতো দেশগুলো দারিদ্র্যে জর্জরিত। দক্ষিণ এশিয়ার ২০ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এতে সামাজিক অসন্তোষ ও অবিশ্বাস বাড়ে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের কারণে বাংলাদেশও বেশ চাপের মুখে পড়ে। উগ্রবাদ বেড়ে গেলে নিরাপত্তা সংকট তৈরি হয়, যা উত্তেজনা আরও বাড়ায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো দেশগুলো অস্তিত্বের হুমকির মুখে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া একটি কৃষি নিবিড় অঞ্চল, এভাবে এই অঞ্চলটি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই এখনও পানি সংকটের সঙ্গে লড়াই করছে, যা সিন্ধু নদীর পানিবণ্টন সম্পর্কিত অসুবিধাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
ভারত পাকিস্তানের কাশ্মির ইস্যুতে লড়াই দীর্ঘদিনের। তবে সাম্প্রতিক সময় হামলায় পর্যটক নিহত ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরোধ তুঙ্গে। অপারেশন সিঁদুর নামে একটি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানও ভারতের বেশ কিছু জায়গায় হামলা চালায়। গত ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন—তার মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তবে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখনও বিরাজ করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অস্থিতিশীলতা প্রসঙ্গে ঢাকার সাবেক এক কূটনীতিক বলেন, এশিয়ার অনেক দেশেই অর্থনৈতিক বৈষম্য আছে, যার ফলে সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া জাতিগত সংঘাত, ধর্মীয় উগ্রবাদ তো আছেই। এটিও রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি কারণ। তবে এক এক দেশে এক এক কারণে অস্থিরতা আছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া কৃষিনির্ভর অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। খাদ্য সংকট তৈরি হলে ফলে সমাজে অস্থিরতা বাড়ে। আবার দীর্ঘদিন ধরে এশিয়ার দেশগুলোতে বিদেশি অনেক রাষ্ট্রের একটা প্রভাব আছে। ওই প্রভাবের কারণেও কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এই ঘটনাগুলোকে ইউনিভারসালাইজ করা যাবে না। এক এক দেশে এক কারণে ঘটে। বিশেষ করে রাজনীতি যখন প্রচণ্ডভাবে পোলারাইজড হয়ে যায়, তখন বিভিন্ন শক্তি সুবিধা নিতে চায়। তাই হয় সাধারণত। তবে আমার কাছে মনে হয় না এই ঘটনাগুলোকে ইউনিভারসালাইজ করা ঠিক হবে।
তিনি বলেন, কিছু দেশ আছে যাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে—যার কারণে তাদের খবর ওইভাবে সামনে আসে না। এই অঞ্চলে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা কোনোটাই নেই। সুতরাং, সব ঘটনাকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন