প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সিলেটঃ সবুজ শ্রীহট্টের ধূসর ভবিষ্যৎ

জাতি হিসেবে আমরা চিরকাল হুজুগে, ঘটনা ঘটার পরেই চোখ খুলে চমকে উঠি, যেন তার আগে কিছুই দেখিনি। গত এক বছরে, শহরের মাঝ বরাবর মহাসড়ক দিয়ে হাজার হাজার ট্রাক ভরে সাদা পাথর বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দিনের আলোয়, মানুষের চোখের সামনে। নদী-পাথরের সেই লুট চলেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে, অথচ আমাদের collective conscience যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল। হঠাৎ একদিন কারও নজরে এলো, “আরে, পাথর তো লুট হয়ে যাচ্ছে!” তখন ততদিনে লুটপাটের খনি শুকিয়ে গেছে, প্রকৃতি হয়ে উঠেছে ফাঁকা মরুভূমি

এই ঘটনাকে শুধুমাত্র কোনো একক ব্যক্তি বা ছোট গোষ্ঠীর অপরাধ বলে চালানো অবিশ্বাস্য। চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই লুটপাটে জড়িত ছিল পুরো একটি নেটওয়ার্ক। জড়িত ছিল স্থানীয় দালাল, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্তা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশও। সবাই মিলে ভাগাভাগি করেছে এই অবৈধ সম্পদ আহরণের মুনাফা, আর প্রকৃতি হয়ে পড়েছে অসহায়।

পাথর নিয়ে যখন দেশজুড়ে আলাপ চলছে, তখনই সবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, সিলেটের পাহাড় ও টিলার কথাও। একই ধরনের নীরব ধ্বংসযজ্ঞ চলছে এখানে বছরের পর বছর। চা বাগানের সবুজ আচ্ছাদন ও পাহাড়-টিলা কেটে বানানো হচ্ছে সমতল জমি, আবাসিক প্লট আর কংক্রিটের অট্টালিকা। এই ধ্বংসের গতি এমন, যে খুব শিগগিরই সিলেটের পাহাড়ের গল্পও কেবল পুরনো ছবিতে আর লোককথায় থাকবে। তখন আমরা আবারও অবাক হয়ে বলব, “আরে! সিলেটের এত পাহাড়-টিলা গেল কোথায়?” কিন্তু ততদিনে ধ্বংস হবে পূর্ণাঙ্গ, আর ফেরানোর মতো কিছুই থাকবে না।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র আমাদের সিলেট একসময় ছিল পাহাড়, টিলা, ঘন বন আর পাহাড়ি ঝরনার অপরূপ সমন্বয়ে গড়া এক অনন্য ভূপ্রকৃতি। কিন্তু গত কয়েক দশকে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু ক্ষয়প্রাপ্তই হয়নি, বরং পরিকল্পিত এবং অব্যাহতভাবে ধ্বংস হয়েছে। আজকের সিলেটের চিত্র হলো, নগরায়নের নামে টিলা কেটে সমতল জমি বানানো, বনভূমি উজাড়, এবং ইকো সিস্টেমের গভীর সংকট।

আপনাদের কিছু পরিসংখ্যান জানানো প্রয়োজন মনে করছি। ২০২০ সালের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বনভূমি প্রায় ১.৮৮ মিলিয়ন হেক্টর, যা দেশের মোট ভূমির মাত্র প্রায় ১৪ শতাংশ। অথচ ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ২,৬০০ হেক্টর প্রাথমিক বনভূমি হারিয়েছে দেশ। ২০০০–২০০৫ সময়ে এই হার ছিল প্রায় ০.৩ শতাংশ বা প্রায় ২,০০০ হেক্টর প্রতি বছর। এই ক্ষয়প্রবণতা শুধু দেশের সামগ্রিক পরিবেশ নয়, সিলেটের পাহাড়ি ভূপ্রকৃতিকেও আঘাত করেছে।

২০০১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সিলেট প্রায় ৭৩৬ হেক্টর গাছ-ঢাকা এলাকা হারিয়েছে, যা মোট সবুজ আচ্ছাদনের প্রায় ২.৬ শতাংশ। গ্লোবাল ফোরেস্ট ওয়াচের তথ্য বলছে, এর ৬৬ শতাংশের বেশি স্থায়ীভাবে বন থেকে উজাড় হয়ে গেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে স্পষ্ট দেখা যায়, একসময়ের ঘন বনাঞ্চল এখন ফাঁকা জমি, চা বাগান বা আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে। এই আর্টিকেলে ১৯৮৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত স্যাটেলাইট ইমেজের একটা তুলনামূলক চিত্র যুক্ত করছি, একটু নজর দিলেই দেখতে পারবেন অপরিকল্পিত নগরায়ণ কিভাবে পুরো সিলেটকে গ্রাস করেছে।

১৯৮৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত স্যাটেলাইট ইমেজে সিলেটের সবুজ অঞ্চলের তুলনামূলক চিত্র

এই ধ্বংসযজ্ঞের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা যায় পাহাড়-টিলা কাটার ক্ষেত্রে। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড ৭, ৮, ২১, যেমন পশ্চিম পীরমহল্লা, টিভি গেট, হালদারপাড়া, তারাপুর চা বাগান, গত দুই দশকে ব্যাপকভাবে পাহাড় কেটে সমতল করা হয়েছে। গত কয়েকদিন আগে তারাপুর চা বাগানে গিয়ে দেখি মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের আবর্জনা চা বাগানে ফেলা হচ্ছে। ২০ বছরে শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ টিলা বিলীন হয়েছে। হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, বোর্ডিং স্কুল, হোটেল, স্টেডিয়াম, বাসাবাড়ি, কোথাও থেমে থাকেনি এই রূপান্তর। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় পর্যায়েই টিলা কেটে ফেলার এমন খোলামেলা দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল

এই ধ্বংসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। একসময় পাহাড়ি টিয়ার ডাক ছিল সিলেটের এক স্বাভাবিক দৃশ্য। এখন সেই টিয়া প্রায় বিলুপ্ত। শুধু টিয়া নয়, অসংখ্য স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি তাদের বাসস্থান হারিয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বানরেরা বাসস্থান হারিয়ে লোকালয়ে নেমে আসছে, খাদ্যের অভাবে খ্যাপাটে হয়ে উঠছে, বাড়িঘরে হানা দিচ্ছে, এমনকি শিশুদের আক্রমণ করছে। সাপ, বেজি, কাঠবিড়ালি, অজগরের মতো বড় সাপও এখন মানুষের বসতিতে ঢুকে পড়ছে, যা একসময় কল্পনার বাইরে ছিল।

এর পাশাপাশি পাহাড় কেটে সমতল করায় পুরো ইকো সিস্টেমে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সিলেট বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা হলেও আগে পাহাড়-টিলার গাছপালা ও মাটি প্রাকৃতিকভাবে পানি শোষণ করে রাখত, ধীরে ধীরে নিচু এলাকায় নামিয়ে আনত। এখন সেই প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলে এক ঘণ্টার ভারি বৃষ্টিতেই শহরের বহু এলাকা জলাবদ্ধতায় প্লাবিত হয়। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তীব্র গরম, শীতকালের দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া, সবই এই ইকো সিস্টেম ভাঙনের সরাসরি ফল।

যদিও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেমন ২০০৫ সালে জাফলং গ্রীন পার্ক প্রতিষ্ঠা, যেখানে প্রায় ১০০ হেক্টর দখলমুক্ত জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে, কিন্তু ক্ষতির তুলনায় তা অতি নগণ্য। তাছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), ভুমিসন্তান এবং বর্তমানে “ধরা” (ধরিত্রির জন্য আমরা), ইত্যাদি সংগঠনগুলি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রচারণা, প্রতিরোধ ও আন্দোলনের মাধ্যমে সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার চেষ্টা করছে। তারা সচেতনতা বৃদ্ধি, গণস্বাক্ষর অভিযান, মানববন্ধন, এমনকি পরিবেশ আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছে। কিন্তু পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধ হয়নি। প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও কার্যকর আইন প্রয়োগ ছাড়া এ ধরণের প্রচেষ্টা কাঙ্ক্ষিত ফল দিতে পারছে না।

প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন একটি স্বতন্ত্র কমিশন, যা সিলেট ও পার্বত্য এলাকার পাহাড়, টিলা ও বনভূমি সংরক্ষণে পূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে কাজ করবে। প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে পাহাড় কাটা অপরাধে দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হয়। পরিবেশ ধ্বংসের এই প্রবণতা যদি এখনই ঠেকানো না যায়, তবে খুব শিগগিরই “দুটি পাতা একটি কুড়ির সিলেট” সমতল বিরান ভূমিতে পরিণত হবে, যেখানে পাহাড়ের গল্প থাকবে কেবল পুরনো ছবিতে আর লোককথায়।

আমাদের জাতীয় অভ্যাসই হলো কোন বিষয় সমাধান নয়, তার পরিণতি নিয়ে হাহাকার করা। সিলেটের পাহাড়-টিলা কেটে সমতল করার কাজ এখনো থামেনি, আর এই গতি অব্যাহত থাকলে খুব অচিরেই পুরো এলাকা হয়ে যাবে একরঙা সমতল ভূমি। তখন হারিয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য, বদলে যাবে জলবায়ু, ছিন্ন হবে প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ, আর নগরের বুকজুড়ে জন্ম নেবে জলাবদ্ধতার দানব।

দুঃখজনক হলেও সত্য, যতদিন না আমরা নিজের চোখে দেখব যে সবুজে মোড়া পাহাড়ের জায়গায় ধূসর মাটি আর কংক্রিটের চৌকাঠ দাঁড়িয়ে আছে, যতদিন না বর্ষার বৃষ্টি নামলেই পুরো শহর ডুবে যাচ্ছে, যতদিন না শীত-গরমের ঋতুচক্র অস্বাভাবিকভাবে বদলে যাচ্ছে, ততদিন আমাদের টনক নড়বে না। তখন হয়তো আমরা আবারও হতবাক হয়ে বলব, “আরে! সিলেটের কি হলো!” কিন্তু সেই উপলব্ধি হবে অনেক দেরিতে, যখন ফেরানোর মতো পাহাড়, টিলা, আর সবুজ কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।

Tags :

Anamul Haque

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025