একটা কথা মনে রাখবেন, বাংলাদেশের সংবিধান যেটার গ্রন্থনা আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ১৯৭২ সালে করেছেন সেটা একটা চমৎকার সংবিধান। আমি তুলনা পছন্দ করি না, কিন্তু আইন, রাজনীতি, সংবিধান এসব বিষয়ে সচেতন যারা তুলনা করতে পছন্দ করেন, তাঁরা সবসময়ই বলেছেন যে এই সংবিধানটা পৃথিবীর অন্যতম সেরা সংবিধান। এটা নিয়ে তর্কের কিছু নেই। কেউ যদি আপনার সাথে এটা নিয়ে তর্ক করতে চায়, হাসবেন। আর কিছু না, হাসবেন।
ত্রুটি কি সংবিধানে নেই? আছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান ধরলে মৌলিক ত্রুটি খুবই কম। পরে যেসব সংশোধন ইত্যাদি হয়েছে, সেগুলো মিলে কিছু গড়বড় হয়েছে। এসব ত্রুটি ঠিক করা খুব কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এটা করবে জনগণ, জনগণের প্রতিনিধিরা। আপনার, আমার কাজ হচ্ছে ত্রুটি যদি কিছু দেখি সেটা চিহ্নিত করা, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা, জনমত তৈরি করা। জনপ্রতিনিধিরা সেগুলো সংশোধন করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে তারা মানুষের কাছে যাবেন, ম্যান্ডেট নেবেন ইত্যাদি।
কিন্তু জনাকয়েক ইংরেজি জানা লোক বসে বসে চা-কফি খেতে খেতে সংবিধান সংশোধন করবেন! মাফ করবেন, মুখ দিয়ে কটু বাক্য বের হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে আর কিছু বললাম না। কেননা গালি একটা দিলে আপনাদের কিছু হবে না, বদনাম হবে আমার। লোকে বলবে- দেখো, ইমতিয়াজ মাহমুদের পরিচ্ছন্ন জিহ্বাটা এসব বদ, কুৎসিত লোকেদের নাম লেগে ময়লা হয়ে গেছে। থাক, কিছু বললাম না।
২. কেন বাহাত্তরের সংবিধানকে প্রশংসা করি আমরা? এর অনেক কারণ আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে সপ্তম অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদটা একটু অভিনব, অন্যান্য খুব বেশি দেশের সংবিধানে এটা পাবেন না। সেখানে কি বলা হয়েছে জানেন? বলা হয়েছে- “৭। (১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।” এর মানে কি? পড়ুন, ভাবুন, প্রশ্ন করুন, আবার ভাবুন।
এটা একটা অনিবার্য কথা, কেউ কেউ বলবেন যে সংবিধানে এটা লিখে রাখার দরকারটা কি। এখন আমরা জানি, ওই ছোট একটা অনুচ্ছেদ যে রাজনৈতিক দর্শনটাকে আমাদের রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করেছে সেটাই সঠিক এবং এখান থেকে যেন আমাদের বিচ্যুতি না হয় সেজন্য এই কথাগুলো লিখে রাখা প্রয়োজন ছিল, জরুরি ছিল।
এখন আমাদের হাসনাত কাইউম ভাই এবং আরও কিছু জারগণপছন্দওয়ালা লোক দেখবেন ফুচুত করে এসে বলে কিনা, সংস্কার চাই সংস্কার চাই- সংবিধান পাল্টাতে হবে। কৌতূহল হয় এসব কথা শুনলে, মনে হয় আচ্ছা দেখি তো ওরা কি সংস্কার চায়, কি সংশোধন চায়, কেন চায়? এটা বললে এরা নানারকম এলেবেলে জারগণ শুরু করে যেগুলো আসলে অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক বাচালতা ছাড়া কিছুই না।
৩. না, সংবিধান বদলানো যাবে না কেন, নিশ্চয়ই যাবে। চাইলে এই সংবিধানের পরিবর্তে নয়া আরেকটা সংবিধানও করা যাবে। কিন্তু কেন করবেন? কী কারণে করবেন? সুনির্দিষ্ট করে বলেন এই সংবিধানের কোন বিধান, কোন চারিত্র্য, কোন বৈশিষ্ট্যটি বদলাতে চান, কেন চান। এটা বলবেন না, তাহলে সংবিধান বদলাতে চাইছেন কেন? আপনার শখের জন্য?
না, আপনার শখের জন্যও আপনি সংবিধানের পরিবর্তন চাইতে পারেন। আইনে তাতে কোনো বাধা নেই। চান। চাইলে কী করবেন? নতুন একটা বই ছেপে দিয়ে দিলেই সেটা নয়া সংবিধান হয়ে যাবে? জি না জনাব। আপনি নির্বাচনে যাবেন, সেখানে গিয়ে মানুষের কাছে বলবেন যে আমি সংবিধান বদল করতে চাই, আমাকে সংসদে পাঠান। মানুষ যদি ভোট দেয়, করে ফেলেন নয়া বই। সিম্পল। আগে ইলেকশনটা করে ফেলেন।
কিন্তু কয়েকজন লোক মিলে একটা ঘরে বসে সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে চাইবেন, সেটা তো হবে না হে মামুর ব্যাটা। এটাকে একটা ষড়যন্ত্র বলতে পারেন, তামাশা বলতে পারেন, ফাইজলামি বলতে পারেন, কিন্তু এসব কর্মকাণ্ডকে কোনোভাবেই সংবিধান সংক্রান্ত বা প্রজাতন্ত্র সংক্রান্ত কোনো বৈধ কাজ বলা যাবে না। আর এসব অকাজে রাষ্ট্রের একটা টাকাও যদি খরচ করে থাকেন, হিসাব দিতে প্রস্তুত থাকেন।