সিলেটে ক্বিন ব্রিজ সংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী আলী আমজদের ঘড়ির ঠিক পাশেই জুলাইয়ের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিফলক ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ নির্মাণ করা হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার অংশবিশেষ আড়াল করে স্মৃতিফলক নির্মাণ নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই পোস্ট দিয়ে এই স্মৃতিফলক নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
১৮৭৪ সালে স্থাপিত আলী আমজদের ঘড়ি সিলেটের একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। এই ঘড়িঘরের বেষ্টনীর মধ্যেই নির্মাণ করা হচ্ছে জুলাই স্মৃতিফলক। এতে ঘড়িঘরের প্রকৃত স্থাপত্যশৈলী আড়ালে পড়ে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন সমালোচনাকারীরা।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি আবদুল করিম চৌধুরী (কিম)। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আলী আমজাদের ঘড়ি একটি পরিবারের দান। এই ঘড়ি সিলেটের ঐতিহ্যের স্মারক। সেই ঘড়িঘরের সীমানার মধ্যে কীসের স্থাপনা তৈরি হচ্ছে? এই স্থাপনা নির্মাণের ফলে এই ঐতিহ্যের সৌন্দর্য্য শুধু বিনষ্ট হবে না, সিলেটের এই ‘সিটি আইকন’-এর স্থাপত্য শৈলী গুরুত্ব হারাবে। আমার ধারণা সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক এই ঐতিহ্য বিনষ্টের অন্যতম পরিকল্পনাকারী। উনার পরিকল্পনায় এখানে ‘জুলাই শহীদ স্মরণে’ নির্মিত হচ্ছে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ। যদি তাই হয়, তাহলে রিকাবীবাজারে কাজী নজরুল ইসলাম অডিটোরিয়ামের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে নির্মাণ করা স্থাপনাটি কেন নির্মাণ করা হয়েছে?’

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কবির য়াহমদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সিলেটে ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ হচ্ছে আলী আমজদের ঘড়ি সংলগ্ন এলাকায়। সিলেটের সুধীজনের একটি অংশ আলী আমজদের ঘড়ি সংলগ্ন এলাকা থেকে এই ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’ সরিয়ে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। সিলেটের গৌরবময় ঐতিহ্যের সঙ্গে মানাইসই নয় এ স্মৃতিস্তম্ভ, মূল বার্তা এটাই। আলী আমজদের ঘড়ি সংলগ্ন এলাকা থেকে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে নিতে হবে বলে ধারণা করছি। সিলেটবাসী তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে আসলে আপস করে না। এখন সিলেটবাসীর সামনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যে প্রশ্ন, সেটা হলো–আলী আমজদের ঘড়ি, নাকি জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ কোনটা বড়?’
সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের প্রধান পরিচালক শামসুল বাসিত শেরো ফেসবুকে লিখেছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ নিঃসন্দেহে মহতী উদ্যোগ, এতে আরেকটু সচেতন হওয়া যায় না? এটা দেখভালের দায়িত্ব সিলেট সিটি করপোরেশনের। সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় জায়গার এত অভাব পড়ল যে শতবছরের ঐতিহ্যবাহী ঘড়িঘরের বাউন্ডারির ভেতরেই স্মৃতিসৌধ করতে হবে? রুচির দুর্ভিক্ষ আর কারে বলে!’
সংস্কৃতিকর্মী নাজিকুল ইসলাম ভূঁঞা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সিলেটকে দেশ-বিদেশে খুব সহজে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে সুরমা নদীর পাড়ে আলী আমজাদের ঘড়িঘরটি আইকনিক নিদর্শন হিসেবে অত্যন্ত সুপরিচিত। দেশ-বিদেশের নানা পর্যটক এখানে আসেন নিয়মিত এটি দেখতে। কিন্তু গতকাল গিয়ে দেখি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে চলেছে। এই ঐতিহাসিক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই কি একটা অদ্ভুত কিসিমের স্থাপনা গড়ে উঠছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম এটি নাকি জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ। শুনে খুব আশ্চর্য হলাম এই ভেবে- গোটা শহরে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ করার কি আর কোনো জায়গা কর্তৃপক্ষ খুঁজে পায়নি? … অবিলম্বে আলী আমজাদের ঘড়িঘরের সীমানা থেকে এই স্থাপনা সরিয়ে নিয়ে দায়িত্বশীলরা শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবেন বলে প্রত্যাশা করছি।’
সংস্কৃতিকর্মী মাসুম খান ফেসবুকে দেয়া পোস্টে লিখেছেন, ‘সিলেট বিভাগ বা জেলাকে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেয় যে কয়েকটি স্থান, চিহ্ন বা ছবি, তার মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্য ও ইতিহাস বহনকারী পর্যটননগরী সিলেটের আলী আমজদের ঘড়িঘর। দীর্ঘদিন থেকে এর আশপাশে নানাভাবে সিলেট সিটি করপোরেশন উদাসীনতা দেখিয়ে ময়লা বহনকারী ট্রাক স্ট্যান্ড বানিয়ে রেখেছে। সার্কিট হাউসের কাছাকাছি এবং সুরমা নদীর তীরে এই ঘড়িঘর একবার দেখার জন্য বিভিন্ন বিভাগের পর্যটক আসেন। তারা দেখে যান এই ঐতিহ্যবাহী জায়গা গাঁজা সেবনকারী এবং পথমানুষ যারা নানা ক্রাইমে জড়িত, তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল! এখন সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে ঘড়িঘড়ের সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই নির্মিত হচ্ছে জুলাই স্মৃতি স্তম্ভ। এতে করে ঘড়িঘরের একপাশ পুরোটা ঢেকে যাবে। পুরো জায়গার সৌন্দর্য্য নষ্ট হবে। আর জুলাই স্মৃতি স্তম্ভ এর মানও থাকবে না। আমি জুলাই স্তম্ভ এর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আরও অনেক জায়গা থাকতে কেন এই ঘড়িঘরের সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই স্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিলো সিটি কর্তৃপক্ষ?’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের স্মরণে প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে ঘটনাস্থলে কিংবা ঘটনাস্থলের পাশে একই নকশায় ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ নামে স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সিলেট নগরে চারজন শহীদের স্মরণে এমন স্মৃতিফলক নির্মাণের কাজ গত জুলাই মাসে শুরু হয় এবং আগস্ট মাসে শেষ হওয়ার কথা। নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন।
সিলেট নগরের সুরমা নদীর পাড় আর সারদা হলের মাঝখানে শহরের জিরোপয়েন্ট। তার ঠিক ১০০ মিটারের মধ্যেই আলী আমজদের ঘড়ির অবস্থান। কিনব্রিজ পার হয়ে শহরের উত্তর অংশের ঠিক প্রবেশমুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এটি ১৮৭৪ সাল থেকে। ওই বছর তৎকালীন বড়লাট লর্ড নর্থব্রুক সিলেটে সফরে এসেছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পৃত্থিমপাশার জমিদার নবাব আলী আহমদ খান ঘড়িটি নির্মাণ করেন। নামকরণ করেন নিজের ছেলে আলী আমজদ খানের নামে।
ঘড়িটি দেখভাল করার দায়িত্বে আছে সিলেট সিটি করপোরেশন। ঘড়িঘরের বেষ্টনীর মধ্যে দুজন শহীদের স্মরণে স্মৃতিফলক নির্মাণের বিষয়ে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, মহানগর পুলিশ, গণপূর্তের কর্মকর্তাসহ কয়েকজনের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি স্থানটি চূড়ান্ত করেছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘটনাস্থলের ঠিক পাশেই স্মৃতিফলক নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া স্মৃতিফলকের নিরাপত্তার বিষয়টিও এখানে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। ফুটপাত কিংবা উন্মুক্ত জায়গায় স্মৃতিফলক নির্মাণ করে পথচারীদের চলাচলের প্রতিবন্ধকতা যেন তৈরি না হয়, সেটাও ভাবনায় ছিল।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাই রাফিন সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, স্মৃতিফলক নির্মাণে গঠিত কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে সিটি করপোরেশন স্মৃতিফলক নির্মাণ করছে। ঘটনাস্থল, স্মৃতিফলক নির্মাণ-পরবর্তী নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পথচারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এ স্মৃতিফলক নির্মাণের পাশাপাশি ঘড়িঘরের সৌন্দর্যবর্ধন করতে রং করা হবে।