অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম’ এর কর্মী স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যু ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোরগোলের মধ্যে ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তসহ তিনটি দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ২৪৩ জন নাগরিক। তাদের মধ্যে লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকেরা রয়েছেন।
তাদের দাবি- যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবিলম্বে আইনের মুখোমুখি করতে হবে। ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষের ভূমিকা ও অবহেলা তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
এছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা, সম্মান ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন দাবি করেছেন তারা।
ঢাকা স্ট্রিমের গ্রাফিক্স ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃতদেহ শনিবার রাতে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয় বলে জানান তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার ইবনে মিজান।
২৮ বছর বয়সী ওই তরুণী আত্মহত্যা করেছেন বলেই স্বজন ও পুলিশের ধারণা। তবে কেউ কেউ তার মৃত্যুর পেছনে অনেকাংশে দায় দেখছেন তিনি যেখানে কাজ করতেন সেই সংবাদমাধ্যমটির শীর্ষ এক কর্তা- আলতাফ শাহনেওয়াজ; যার বিরুদ্ধে ‘যৌন নিপীড়ন’, ‘বাজে আচরণের’ মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছিলেন স্বর্ণময়ীসহ ২৬ কর্মী।
মঙ্গলবার ২৪৩ নাগরিকের পক্ষে বিবৃতিটি সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা এবং কবি ও সাংবাদিক গিরীশ গৈরিক।
বিবৃতিতে যারা সম্মতি জানিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, আইনজীবী জেড আই খান পান্না, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল বায়েস, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন ও অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহান।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানতে পেরেছি যে, অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘ঢাকা স্ট্রিম’–এর গ্রাফিক ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাস (২৮) আত্মহত্যা করেছেন।’
‘সম্ভাবনাময় এক তরুণ সংবাদমাধ্যমকর্মীর অকাল, অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।’
প্রতিষ্ঠানটির ২৬ সংবাদমাধ্যমকর্মীর লিখিত ও ‘প্রমাণসাপেক্ষ’ অভিযোগের পরও ঢাকা স্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি, সেই প্রশ্নও তোলা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তা করেনি; বরং তাকে দায়িত্বে বহাল রাখা হয়। আমরা মনে করি, এ ঘটনায় সংবাদমাধ্যমটির সম্পাদক-প্রকাশক এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান তাদের নৈতিক ও প্রশাসনিক দায় এড়াতে পারেন না।’
‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও অভিযোগ তদন্তের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ঘটনায় সেই নির্দেশনা মানা হয়নি, যা আইন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সহকর্মীদের ভাষ্যমতে, বিচার না পেয়ে স্বর্ণময়ী বিশ্বাস মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন, হতাশা ও বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন।’
এ ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, এটি বাংলাদেশের নারীকর্মীদের কর্মপরিবেশের ভয়াবহ বাস্তবতাকে প্রকাশ করে বলেও মনে করেন বিবৃতিদাতারা।
তারা বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের মতো অপরাধ ঘটেই চলেছে; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার সঠিক বিচার হচ্ছে না। ফলে অসংখ্য নারী নীরবে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন, কেউ কেউ বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন, কেউ আবার অপমান ও হতাশা সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।’
‘আমরা মনে করি, স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যু দেশের সাংবাদিক সমাজ, সৃজনশীল মানুষ ও নাগরিক বিবেকের জন্য এক কঠিন প্রশ্ন রেখে গেছেন। এ ঘটনায় আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি। স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যু যেন আরেকটি ‘সংবাদ’ হয়ে হারিয়ে না যায়। আমরা চাই, তার মৃত্যু হোক পরিবর্তনের সূচনা, ন্যায়বিচারের জাগরণ।’




