শেখ হাসিনার জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন?

বিবিসি’র প্রতিবেদনটি স্রেফ তথ্য। শেখ হাসিনা গুলি করতে নির্দেশ দিয়েছেন নাকি দেননি, অডিও কন্ঠটি তার নাকি তার নয়, অডিওটি ২০২৪ সালের নাকি ২০১৬ সালের হলি আর্টিজেনের সময়ের- এই প্রতিবেদন দিয়ে আপনি বড়জোড় তথ্য পাবেন, আর কিছু না।

মূলত অডিও টেপটি হলি আর্টিজেন সময়ের হলে শেখ হাসিনা দায়মুক্ত হন তার ভক্তদের কাছে। অপরদিকে যারা শেখ হাসিনাকে অন্ধভাবে সহ্য করতে পারেন না তাদের কাছে এই টেপটি ২০২৪ সালের হতেই হবে যাতে হাসিনার প্রতি তাদের ঘৃণার একটা বাস্তব কারণ থাকে। এ ধরণের ফোন কল, ভিডিও, ছবি আদালতে প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হয় না বলেই জানি। আপনি যদি আপনার রায় দোষী অথবা নির্দোষ হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর প্রয়োগ করেন সেটি করার আগে আমি কেবল কিছু কথা বলতে চাই। কথাগুলো শুনলে লাভ হবে এতটুকুই, আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞান আবেগশূন্য হবে এবং রাজনীতির নিষ্ঠুর দুনিয়া সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ হবে।

মনে করুন হোয়াইট হাউস দখল করার জন্য ‘ছাত্র-জনতা’ এগিয়ে আসতে থাকল আর চারদিক থেকে ঘেরাও করতে চাইল। তখন ঠিক কী করা হবে জানেন? কয়েক মিনিটে কয়েকশ লাশ ফেলে দেয়া হবে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টেকে রক্ষা করতে এবং এটি কোনো অন্যায় বলে ধরা হবে না।

আবার দেখুন, এখন যমুনা হচ্ছে গণভবনের মতোই একটি স্থান। সেখানে যে কোনো পরিচয়ে উত্খাতের লক্ষ্যে যদি ঘেরাও কর্মসূচি নেয়া হয়, প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিতরা ফায়ারিং করবে। এতে যত খুশি মারা যায় যাবে। সরকার ফেলে দেয়া একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সরকারটি ক্ষমতায় আছে।

জুলাই আন্দোলন অহিংস কোনো আন্দোলন ছিল না- সেটি এই আন্দোলনের অন্ধ যে কোনো সাপোর্টারও স্বীকার করবেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার কোনো হুকুম সেদিন দেয়া হয়েছিল কি? আইনগতভাবেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি করার নির্দেশ রাষ্ট্র দেয় এবং এটি পরিস্থিতি বিবেচনায় বৈধ। ঢাকা মেডিকেল, রামপুরা টেলিভিশন ভবন, মেট্রো রেল এগুলো কেউ মানুষ নয় সত্যি। এগুলো আবার তৈরি করা যাবে, কিন্তু কোনো মানুষ আর ফিরে আসবে না- সেটাও সত্যি। তবে কথাগুলো রাজনীতির বাইরের কথা। কোনো রাষ্ট্র যখন সহিংস আন্দোলনকারীদের হাতে এভাবে আক্রান্ত হবে, তখন সরকারের কাজ হচ্ছে সেই হামলাকারীদের ওপর কঠোর হওয়া। সোজাসাপ্টা গুলি করে হলেও দমন করা। ইউরোপের যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ, সেসব দেশেও জিন্মি উদ্ধারে সরকারপ্রধান গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন। আর সরকার ফেলে দেয়ার কোনো চক্রান্ত হলে তো কথাই নেই!

একাধিক সমন্বয়ক আত্মস্বীকৃত হয়েছেন যে, পুলিশ না মারলে, মেট্রোরেলে আগুন না দিলে সরকার পতন হতো না। পুলিশের দিকে আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে গুলি করার উস্কানিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মোটিভ ধরা পড়ে, যেখানে সরকার গুলি চালাক সেটি কাম্য ছিল তাদের কাছে।

সহিংস একটি আন্দোলনে যেখানে পুলিশ টার্গেট, সেরকম একটি পরিস্থিতিতে অন্যরা কী করতেন সরকারে থাকলে? ইন্দিরা গান্ধি নকশাল আন্দোলনের সময় কী করেছিলেন? পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে ফেলে দেয়ার কমিউনিস্টদের সশস্ত্র এই গৃহযুদ্ধে সরকার কি দুই হাত তুলে কীর্তন গেয়েছিল? ধরা যাক, নকশালরা পুরো ভারত দখল করে কমিউনিস্ট সরকার কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে। তখন ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যার জন্য বিচার করা হতো, তাকে খুনি, ডাইনি… সবকিছু বলেই অভিহত করা হতো। কিন্তু আপনি বলেন তো, ইন্দিরা গান্ধির হাতে আর কী করার ছিল তখন? তার বিরুদ্ধে তো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। ‘শ্রেণিশত্রু খতম’ করার মতো নকশালদের গলাকাটা হত্যাগুলোর প্রেক্ষিতে সরকারপ্রধান হিসেবে তার কি উচিত ছিল ক্ষমতা থেকে নেমে গিয়ে ফুল দিয়ে নকশালদের অভ্যর্থনা জানানো? তুরস্কে অতিসম্প্রতি এরদোয়ান ছাত্রদের কী করেছিল? জাপানের মতো শান্তিপূর্ণ দেশে ছাত্র আন্দোলনের সময় সরকার কী করেছিল, গুগল করেন তো। চীনে দশ হাজার ছাত্র খেয়ে দিয়েছিল কমিউনিস্ট সরকার।

আর সেদিন গণভবনে শেখ হাসিনাকে এই ‘ছাত্র-জনতা’ রাশিয়ার জারের পরিবারকে যেভাবে নৃশংসভাবে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল, সেভাবেই মারত। এই নৃশংসতা নিয়ে কোনো মানবতাবাদী রুশকে পাওয়া যায়নি প্রতিবাদ করতে, কারণ সেদিন বলশেভিকরা জয়ী হয়েছিল। শেখ হাসিনা পরাজিত হয়েছিল তাই সে গণহত্যা করেছে! তিনি জয়ী হলে সমন্বয়কদের অনেককেই পুলিশের ওপর গণহত্যার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতো। খুব সিম্পল জিনিস। আপনারা দুটো অন্ধ সমর্থক গোষ্ঠী যখনই মানবতাবাদের পক্ষে দাঁড়ান, তখন খোদ মানবতাবাদ জিনিসটাকেই বিতর্কিত করে ফেলেন।

আমি খুবই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলছি। এ রকম ঝুঁকি কেউ নিতে চাইবে না। যারা দলীয় রাজনীতির প্রকাশ্য সাপোর্টার তারা অন্যায়কেও চোখ বুজে সমর্থন করবে। কিন্তু কোনোরকম রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই বলা চলে আগস্টের শেষ কয়েকদিন সহিংস সশস্ত্র ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ সেদিন যা করেছে, যে কোনো সরকার সেদিন ক্ষমতায় থাকলে সেটাই করত। এরশাদবিরোধী আন্দোলন বা ৬৯ এর ছাত্র-জনতার আন্দোলন আর ২৪ এর জুলাই আন্দোলনের ধরণ-ধারণ একেবারেই আলাদা। জামায়াত-শিবির যে আন্দোলনের সমানের কাতারে থাকে, সে আন্দোলনের চেহারা রাষ্ট্রবিরোধী সহিংস চেহারা নেবেই।

রাজনীতি খুবই অপছন্দের জিনিস আমার কাছে। রাজনীতিবিদদের মহামানব বানানোর যে কাল্ট সারা পৃথিবীতে চলমান, তার বাইরে তাদেরকে চতুর, শঠ, মিথ্যাবাদী, অভিনেতা, সুযোগসন্ধানী বলেই আমার মনে হয়। তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে অরাজনৈতিক লোকজন যখন রাজনীতিতে আসে আর মানবতার বুলি কপচায়! এখন যেটা রোজ দেখছি …।

Tags :

Susupto Pathok

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025