মুরাদনগরে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের ঘটনাটির বর্ণনা দেখেছেন আপনি? না, নারীটিকে কোথাও একা পেয়ে ধর্ষণ করেছে বা সেরকম কোনো ঘটনা নয়। মেয়েটি যে বাড়িতে ছিল, সেখানে গিয়ে ধর্ষক তার ধর্ষ্ণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে। ভয়ে নারীটি ঘরের দরজা আটকে দেয়। ধর্ষক দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে ও নারীটিকে ধর্ষণ করে চলে যায়। ভাবখানা এমন যে ধর্ষণ করা তার অধিকার এবং ধর্ষণ করা থেকে কেউ তাকে বাধা দিতে পারবে না। বিস্ময়কর লাগছে? আরেকটা তথ্য যুক্ত করি, তাইলে আর অবাক লাগবে না।
নারীটি ধর্ম বিশ্বাসে হিন্দু আর ধর্ষক একজন মুসলমান। এই পোড়ার দেশে একটি হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করতে চাওয়া খুব বড় কোনো অপরাধ বিবেচিত হয় না। আসলে ধর্ষণ ব্যাপারটাকেই আমাদের দেশে এমনিতে বড় কোনো অপরাধ বিবেচনা করে না বেশিরভাগ মানুষ। ধর্ষণের শিকার নারীকেই সাধারণত কোনো না কোনোভাবে দায়ী করা হয় ধর্ষণের জন্য। মুরাদনগরের মেয়েটি শুধু যে নারী সেটাই কেবল নয়, তিনি একজন হিন্দু নারী। নারীকে আমরা পূর্ণ মানুষ মনে করি না এবং হিন্দুদেরকে আমরা পূর্ণ নাগরিক মনে করি না। ফলে হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে ধর্ষক যদি কোনো সঙ্কোচ না করে বা ভয় না পায়, সেটাতে তো বিস্ময়ের কিছু নেই।
না, কেবল বিচারের দাবি করছি না। বিচার পাওয়া তো ভিক্টিমের অধিকার, আর সেটা নিশ্চিত করা সে তো সরকারের দায়িত্ব। বিচার তো হবে। আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করছি, সত্যটা এড়িয়ে যাবেন না। মুরাদনগরের এই ঘটনাটি একটি সাম্প্রদায়িক অত্যাচারের ঘটনা। এটা যতদিন আমরা স্বীকার না করবো, ততদিন আমরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ করতে পারবো না। এটা একটা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, এই নারীটি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনি হিন্দু বলেই। ওঁর জায়গায় একজন মুসলিম নারী হলে ধর্ষক সম্ভবত এতো বেপরোয়া হতো না।
আপনি আপনার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলুন, বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো মানুষ কি নিজেকে পূর্ণ নিরাপদ মনে করে? করে না। হিন্দুরা আমাদের এখানে সবসময় আতঙ্কে থাকে। একজন হিন্দু এই দেশে মুসলমানদের সমান ভাবতে পারে না নিজেকে। কেন? কারণ সেই ১৯৪৭ থেকে অদ্যাবধি এই দেশে আমরা সেই পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি। আমি এমন পরিবার জানি, যারা নিজের মেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেখানেই পড়াশোনা, বিবাহ ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে। কেন? কারণ মেয়েটির বাবা-মা এদেশে নিজের কন্যাকে নিরাপদ মনে করেননি। আপনি কি এরকম কাউকে জানেন না? খোঁজ নিন আপনার আশপাশে, দেখবেন, পাবেন।
প্রকৃত সমস্যা উপেক্ষা করবেন না। প্রকৃত কারণটি চিহ্নিত করুন এবং সেটা স্পষ্ট কণ্ঠে স্বীকার করুন। আমাদের দেশে তীব্র সাম্প্রদায়িকতা বিরাজ করে এবং প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে দেশের কোথাও না কোথাও হিন্দুদের সাথে অন্যায় করি আমরা। এমনিতেই দেশের সকল মানুষই আতঙ্কে থাকে, পুলিশ ঠিকমতো কাজ করে না, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নাই, গুণ্ডার দল কখন কার বাড়িতে দলবেঁধে এসে হাজির হবে কেউ জানে না। হিন্দু নাগরিকদের এই নিরাপত্তাহীনতা মুসলিম নাগরিকদের তুলনায় দ্বিগুণ, কেননা বাড়তি হিসেবে ওদের প্রতিনিয়ত শঙ্কায় থাকতে হয় সম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের। কেবল ধর্মবিশ্বাসের কারণে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হওয়া এই দেশে অভিনব কিছু নয়।
মেহেরবানী করে সাম্প্রদায়িকতাকে আরেকটি আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি ইস্যু ভাববেন না। সাম্প্রদায়িকতা এখন এমনভাবে ছড়িয়েছে যে এমনকি আপনি যাদেরকে বাম, প্রগতিশীল, লিবারেল বা সেক্যুলার হিসেবে চেনেন, ওদের পেটের মধ্যেও ঠিকই লুকিয়ে থাকে সাম্প্রদায়িকতা। আমি তো এমনকি এক-দুইজন কমিউনিস্টের মুখেও ঐসব কথা শুনেছি, যেগুলো স্পষ্টতই পেটের অভ্যন্তরে বিরাজমান সাম্প্রদায়িকতা থেকে উৎসারিত।
ভুলে যাবেন না, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একটা দেশ কখনোই সভ্য হতে পারে না, গণতন্ত্র তো দূর কি বাত।