ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’ (আইসিজি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য ক্রাইসিস গ্রুপের এই বক্তব্যকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইসিজি তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম জোরদার করেছে এবং সীমান্তবর্তী ক্যাম্পগুলোতে যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
সংস্থাটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, যদি এই দুই পক্ষ যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও নষ্ট হবে, যা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তুলবে এবং নতুন করে আরও শরণার্থী বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হতে পারে।
‘রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র তৎপরতার ঝুঁকি’ এবং আইসিজি’র দাবি
‘বাংলাদেশ/মিয়ানমার: রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র তৎপরতার ঝুঁকি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আইসিজি উল্লেখ করেছে, গত বছরের শেষ দিকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে রাখাইন রাজ্যের দখল নেয় আরাকান আর্মি। ওই ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো আরও সংগঠিত হতে শুরু করে এবং নিজেদের শক্তি বাড়াতে নতুন করে সদস্য সংগ্রহ করছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সমর্থিত আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুসলিম রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ধর্মকে ব্যবহার করছে।
আইসিজি সতর্ক করেছে, যদি কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা থামানো না যায়, তাহলে সেটি বাংলাদেশের জন্য “মারাত্মক ক্ষতি” বয়ে আনতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, আইসিজি’র দাবি সত্য হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও প্রকট হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের অস্বীকার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের উদ্বেগ
নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, “যুদ্ধ শুরু হলে তখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অনিরাপদ হয়ে পড়বে। আরাকান আর্মি সেখানে ঢুকে তাদের প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালাতে চাইবে। সব মিলিয়ে বিষয়টি দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকিতে পরিণত হবে।”
তবে বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ক্রাইসিস গ্রুপের এই অভিযোগগুলোকে অস্বীকার করেছেন। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “ক্যাম্পে সশস্ত্র তৎপরতা চলছে, ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে– এগুলো অসত্য কথাবার্তা। উনারা যা বলছেন, সেগুলোর কোনো এভিডেন্স (প্রমাণ) নেই।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সবসময় ক্যাম্পগুলো মনিটর করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। তাদের চোখের সামনে এগুলো ঘটবে, এটা অসম্ভব ব্যাপার।”
রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর ঐক্য ও সংঘাতের নতুন সমীকরণ
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সক্রিয় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গ্যানাইজেশন (আরএসও) সহ যত সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, তারা সম্প্রতি একজোট হয়েছে। অতীতে নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত থাকলেও আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর তাদের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। গোষ্ঠীগুলোর নেতারা মনে করেন, উত্তর রাখাইনের যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল, সেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকা উচিত। তাই তারা নিজেদের মধ্যে হানাহানি থামিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
আইসিজি’র প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহিংসতা বন্ধের আশায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোও তাদের এই সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছে। যদিও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এই অভিযোগগুলোকেও ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করছেন। ক্রাইসিস গ্রুপ বলছে, রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারায় কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে সহিংসতা কমে গেছে। তবে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা কমেনি, বরং বেড়েছে।
ধর্মকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার এবং সদস্য সংগ্রহ
আগে সাধারণ রোহিঙ্গারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিতো না, যার ফলে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতে তাদের বেগ পেতে হতো। তবে আইসিজি জানাচ্ছে, এখন গোষ্ঠীগুলো কৌশল বদলেছে এবং নতুন সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ধর্মকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযানকে তারা “অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ” হিসেবে অভিহিত করছে, যা শরণার্থী শিবিরগুলোকে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সদস্য সংগ্রহের “উর্বর ক্ষেত্রে” পরিণত করেছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিজেদের শক্তি বাড়াতে মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের চেষ্টা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা রোহিঙ্গা পুরুষদেরকে জোর করে আধা-সামরিক ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করে। এছাড়াও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা সরকার একটি সমঝোতা করার চেষ্টা করছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব
আইসিজি সতর্ক করেছে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর এই তৎপরতা আরও তীব্র হলে তা সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিক, আরাকান আর্মি এবং বাংলাদেশ– সব পক্ষের জন্যই মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনবে। সংস্থাটির মতে, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর অভিযান সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু এরপরও সরাসরি সংঘর্ষে জড়ালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যাবাসন উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং মিয়ানমারেও রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব আরও বেড়ে যেতে পারে।
“এতে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের মধ্যে আরও রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়াবে এবং সেই সংঘাত থেকে বাঁচতে সেখানকার রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে,” প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আইসিজি। সংস্থাটি আরও মনে করে, “এটি বাংলাদেশ সরকারের জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা আরও কঠিন করে তুলবে। কারণ গোষ্ঠীটি মনে করে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে।”
সমাধানের পথ: আস্থা স্থাপন ও আন্তর্জাতিক সহায়তা
সংঘাত এড়াতে আরাকান আর্মি, রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশ- এই তিন পক্ষের মধ্যেই আস্থার সম্পর্ক তৈরি করা “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ” বলে মনে করে ক্রাইসিস গ্রুপ। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালানো এবং নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছে। সেই সঙ্গে আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের যোগাযোগ আরও বাড়ানো উচিত বলেও তারা মনে করেন।
আরাকান আর্মিকে উদ্দেশ্য করে আইসিজি বলেছে, তাদের উচিত বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছে প্রমাণ করা যে রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে তারা শাসনকাজ চালাতে পারে এবং মতপার্থক্য নিরসনে তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক।
পরিশেষে, আইসিজি আন্তর্জাতিক দাতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সহায়তা বাড়ানোর বিষয়ে মনোযোগ দিতে। সংস্থাটি সতর্ক করেছে, “ব্যাপকভাবে সহায়তা হ্রাস শরণার্থীদের মধ্যে স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট এবং হতাশাকে আরও গভীর করে তুলবে, যা রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র তৎপরতাকে ইতোমধ্যেই অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।”
সূত্র : আইসিজি, বিবিসি