রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নিয়ে সরকারের ‘লুকোচুরি’র কারণ কী?

আমেরিকার আরোপিত অতিরিক্ত ৩৫% ট্যারিফ কমানোর জন্য দফায় দফায় আলোচনা করে নাকি সরকারের আলোচকবৃন্দ ‘বিশাল অর্জন’ করে এসেছেন। প্রধান উপদেষ্টার কথায়― “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়। তিনি বাংলাদেশের শুল্ক আলোচক দলকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আমরা গর্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক বাণিজ্য চুক্তি নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের শুল্ক আলোচক দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই—এটি নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয়। শুল্কহার প্রত্যাশিত হারের চেয়ে ১৭ পয়েন্ট কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনে আমাদের আলোচকরা যে অসাধারণ কৌশলগত দক্ষতা ও দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় অটল অঙ্গীকার দেখিয়েছেন, তা প্রশংসার দাবিদার।“

প্রকৃত সত্য হলো বাংলাদেশের পণ্যের ওপর আগে থেকেই ১৫% ট্যারিফ বলবত ছিল। তার ওপর আরও ৩৫% আরোপ করেছিল। রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ নিয়ে দরকষাকষির আগে ‘ননডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে কার্যত বাংলাদেশকে ‘আমেরিকার গোলাম’ বানিয়ে ১৫% কমানো গেছে। সরল বাংলায় আগের ১৫%সহ আরোপিত ৩৫% যোগ হয়ে মোট ৫০% থেকে ১৫% কামাতে পেরেছে। তার পরও বলবত থাকবে ৩৫% (আগের ১৫%+আরোপিত ২০%)।

এটা নিয়ে ‘যুদ্ধজয়ের মত’ বগল বাজানোর আগে দেখে নেওয়া যাক এই ট্যারিফ কীভাবে বাংলাদেশের বাণিজ্যকে ধ্বংস করবে।

আমেরিকার বাজারে প্রধানত: বাংলাদেশ থেকে আরএমজি রফতানি হয়। বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বৈশ্বিক রপ্তানির ১৭ থেকে ১৮ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে। আর্থিক পরিমাণে যা প্রায় আট বিলিয়ন ডলার। এর সিংহভাগ রফতানি হতো স্থল বন্দর দিয়ে ভারতের দিল্লি বিমান বন্দরে একটি বিশেষ ডাম্পিং জোনে ডাম্প করা হতো। সেখান থেকে বিমানে আমেরিকা-ইউরোপে পাঠানো হতো।

দেড় মাস আগে ভারত সেই সুবিধা বাতিল করেছে। বেশিরভাগ গার্মেন্ট পণ্য স্থল বন্দর দিয়ে ঢুকে ভারতের সমুদ্র বন্দরে যেতো। সেখান থেকে জায়ান্ট ভেসেলে আমেরিকায় যেতো। যে সুযোগ এখন বাতিল। এখন পাঠাতে হবে সমুদ্র পথে চট্টগ্রাম থেকে ভারতের নভশেবা বন্দরে, সেখান থেকে জায়ান্ট ভেসেলে আমেরিকায়।

ভারত এই রোড এন্ড এয়ার ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করায় এখন ক্যারিং কস্ট প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আগে ১৫% ট্যারিফ এবং ভারতের ট্রানজিট সুবিধায় কম খরচে পাঠানো পণ্যে যে প্রফিট হতো এখন আর তা হবে না। তার উপর এখন ট্যারিফ গুনতে হবে ৩৫%।

এই বিপদ সম্পর্কে সরকার চুপ করে থাকলেও গার্মেন্ট মালিকরা বিপদ এড়াতে পারছে না। তাদের আশঙ্কা এতে করে আগামী এক-দুই মাসের মধ্যেই ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কয়েকশ’ ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে ৬ থেকে ৮ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারাবে

১১ই জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে ওয়াশিংটন ডিসিতে নিজ কার্যালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জেমিসন গ্রিয়ার।

এবার নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের ফলে বাংলাদেশ কোন অতল গহ্বরে পড়তে যাচ্ছে সেটা দেখা যাকঃ

সরকারের তরফে এখন পর্যন্ত কোনও সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি, কারণ চুক্তিটির নামই Non-Disclosure Agreement বা NDA, এর শর্তাবলী সাধারণত প্রকাশ করা হয় না, কারণ এটি একটি গোপনীয় চুক্তি। আগে অন্তত SOFA, TICFA এগ্রিমেন্ট নিয়ে তবুও আলোচনা করা যেত, এবার NDA তে সে সুযোগ নেই।

তার পরও বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে-

১। আমেরিকা থেকে ‘স্পেশাল রেটে’ ২৫টি বোয়িং বিমান কিনতে হবে।

২। রাশিয়া-ইউক্রেন-ভারত-ব্রাজিল থেকে গম কেনা যাবে না। কিনতে হবে আমেরিকা থেকে চড়া দামে।

৩। রাশিয়া ও চীন থেকে সামরিক সরঞ্জামাদি কেনা যাবে না।

৪। আমেরিকা থেকে আমদানি করা পণ্যে শূন্য শুল্ক বলবত হবে।

৫। টেক্সটাইল সেক্টরের অন্যতম কাঁচামাল তূলাও আমেরিকা থেকে কিনতে হবে।

এরকম আরও কিছু শর্ত আছে যা কখনোই প্রকাশ করা হবে না, কিন্তু বলবত হবে। কেবলমাত্র বলবত হওয়ার পরে ক্ষতির পরিমাণ দেখেই বোঝা যাবে কোন কোন খাতে কী কী চুক্তিতে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, সামরিক সক্ষমতা প্রায় পুরোপুরি আমেরিকার গ্রিপে চলে গেছে।

বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর যুদ্ধাস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামের জন্য মূলত চীন ও রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল। দেশে যে গোলাবারুদ উৎপাদন হয় সেই কারখানাটিও চীনের সহায়তায় চলে। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সমরাস্ত্র প্রায় পুরোপুরি চীনের উপর নির্ভরশীল। এর কারণ তুলনামূলক কম দাম এবং রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও স্পেয়ার পার্টসের সহজলভ্যতা।

নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ চীন এবং রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারবে না। এটা শুধু NDA তে উল্লেখ করেই শেষ হয়নি, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য এফেয়ার্স গত সপ্তাহে সেনাসদরে গিয়ে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারকে এই বার্তা দিয়েছে এসেছে যে, চীন এবং রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা বন্ধ করা না হলে সরাসরি স্যাঙ্কশন আরোপ করা হবে। একই বার্তা তিনি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ইউনুসকে।

সামরিক বাহিনী যদি চীন এবং রাশিয়া থেকে সরঞ্জাম কেনা বন্ধ করে দেয় তাহলে এই দুটি দেশের প্রতিক্রিয়া কী হবে? বাংলাদেশের প্রায় পুরো সামরিক সক্ষমতা যে দুটি দেশের উপর নির্ভরশীল তারা যদি মেইনটেইন্স সহায়তা বন্ধ করে দেয় তাহলে দেশের সামরিক বাহিনীর বেশিরভাগ যুদ্ধাস্ত্র জাস্ট খেলনায় পরিণত হবে

চীন-রাশিয়া আমেরিকার মত হম্বি-তম্বি করে না। তারা কাজ করে নীরবে। চীনের সঙ্গে যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিসমূহ রয়েছে তা ভঙ্গ করলে চীন মুখ ফিরিয়ে নেবে। কেননা চীনের বাজার বিশ্বজুড়ে। আর বাংলাদেশ চীনের ওপর শুধু সামরিক সরঞ্জামাদি নয়, প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার গার্মেন্ট সেক্টরও মুখ থুবড়ে পড়বে, কারণ গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামালের ৬০-৭০ শতাংশই আসে চীন থেকে

ইন্টেরিম প্রধান চীনে গিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেদের ‘গার্ডিয়ান অব দ্য ওশান’ বলে বাংলাদেশে চীনকে বিনিয়োগের জন্য শতভাগ প্রায়োরিটি দিয়ে এসেছিলেন। এখন আমেরিকার চাপে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করা বা কমিয়ে দেওয়া চীন মেনে নেবে না। কোনও সাড়াশব্দ হবে না, অথচ হাত-পা খোঁড়া হয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলাদেশ।

আমেরিকার রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ কমানোর জন্য চীন এবং রাশিয়ার সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক অফিসিয়ালি নষ্ট করে দেয়া হলো। এর প্রতিক্রিয়ায় চীন-রাশিয়া যদি বাংলাদেশে খাদ্যপণ্য, সামরিক সরঞ্জাম, গার্মেন্ট সেক্টরের কাঁচামাল রপ্তানীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী।

শাসন ক্ষমতায় বসানো এবং টিকে থাকার গ্যারান্টি পাওয়ার জন্য আমেরিকার ফাঁদে পা দিয়ে বাংলাদেশকে এক অনিশ্চিত গন্তব্যে ঠেলে দিয়ে কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন মুহাম্মদ ইউনূসের ইন্টেরিম সরকার। দেশ স্বাধীনের পর P.L. 480 প্রকল্পের আওতায় খাদ্যশস্য, বিশেষ করে গম সরবরাহ করার কথা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশবাসীর মনে আছে সেই গম মাঝপথেই ফেরৎ নিয়েছিল তারা। তার ফলেই বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল দুর্ভিক্ষ। যে দুরাবস্থাকে ব্যঙ্গ করে ‘বটমলেস বাস্কেট’ বলেছিল নিক্সন। ইন্টেরিম রিসেট বাটন টিপে আবার সেই সত্তরের দশকে নিয়ে ফেলল দেশটাকে। এবার কে বাঁচাবে? ভারত-চীন-রাশিয়া কারও কাছেই সাহায্য মিলবে না। আমেরিকা? ওয়েট এন্ড সী….

মনজুরুল হক
২ আগস্ট ২০২৫

Tags :

Monjurul Haque

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025