রাখাইনে মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের লুকোচুরি খেলার কারন কি?

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের পরস্পরবিরোধী বিবৃতিতে জনমনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এপ্রিলের শেষ থেকে জুন মাসের শুরু পর্যন্ত চলে আসা এই অস্পষ্টতা সরকারের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ এবং রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অবস্থান সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে। সরকারের এই ধোঁয়াশা সিদ্ধান্ত সাধারণ দেশপ্রেমিক জনগণ স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। 


মানবিক করিডোর বিতর্ক: শুরু থেকে শেষ

২৭ এপ্রিল: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জনাব তৌহিদ প্রথম এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। তিনি জনসমক্ষে জানান, “নীতিগতভাবে আমরা ‘’মানবিক করিডোরে’’ সম্মত। এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে। সেই শর্তগুলো পূরণ হলে আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে অবশ্যই সহযোগিতা করব।” প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই বিবৃতি ব্যাপক আলোচনা ও আশংকা তৈরি করে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মূলধারার সমাজকর্মী – সবার মনেই এই বিষয় নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তথ্যসুত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, ২৭ এপ্রিল ২০২৫।

৩০ এপ্রিল: মাত্র দু’দিন পর, প্রেস সচিব শফিকুল আলম সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করে একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে আলোচনা করেনি। আমাদের অবস্থান হলো, রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সহায়তা থাকে, তাহলে বাংলাদেশ রসদ সহায়তা দিতে ইচ্ছুক।” এতে বোঝা যায়, একটি প্রতিষ্ঠিত ‘করিডোর’ নয়, বরং রসদ সহায়তা প্রদানের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিগত সম্মতি রয়েছে। তথ্যসুত্রঃ দৈনিক যুগান্তর, ৩০ এপ্রিল ২০২৫।  

২১ মে: জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমান টিবিএস নিউজ বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশ ‘করিডোর’ নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি। তবে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি ‘চ্যানেল’ তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে।” এখানে ‘করিডোর’ এর বদলে ‘চ্যানেল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যা বিষয়টিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে। তথ্যসুত্রঃ দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা, ২১ মে ২০২৫।

৪ জুন: এই অস্পষ্টতা চরমে পৌঁছায় যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস বক্তব্য দেন। তিনি স্পষ্ট জানান, কক্সবাজার হয়ে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা করিডোর চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই সংবাদটি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রাথমিক বক্তব্যের সরাসরি বিপরীত ছিল। তথ্যসুত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, ০৪ জুন ২০২৫।

৬ জুন: সর্বশেষ, ঈদুল আযহা উপলক্ষে শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস এ ব্যাপারে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি রাখাইনের জন্য বাংলাদেশ করিডর দিয়ে দিয়েছে বলে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি এটা সর্বৈব মিথ্যা। এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা অসত্য কল্পকাহিনী বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।’ 

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরকালে রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য একটি ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়েই রয়ে গেছে।’ এই বিবৃতিটি যেকোনো ‘করিডোর’ প্রতিষ্ঠার দাবিকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে এবং তার অধস্তনদের দেয়া বক্তব্যকে মিথ্যা দাবি করে। তথ্যসুত্রঃ দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বাংলা, ০৬ জুন ২০২৫।

দৈনিক প্রথম আলো ২৭ এপ্রিল ২০২৫

কে সত্য বলছেন?

এই ধারাবাহিক পরস্পরবিরোধী বক্তব্যগুলো একটি সংবেদনশীল মানবিক বিষয় নিয়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতি স্পষ্ট করে। একদিকে যেমন কিছু কর্মকর্তা ‘মানবিক প্যাসেজ’ বা ‘করিডোরে’ নীতিগত সম্মতির ইঙ্গিত দিয়েছেন, অন্যদিকে অন্যরা বলেছেন যে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। তারা বলছেন লজিস্টিক্যাল সহায়তা বা ‘চ্যানেল’ তৈরির প্রস্তাব বিবেচনাধীন। জাতিসংঘের নিজস্ব প্রতিনিধির সরাসরি অস্বীকার বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়েছে।

এই ঘটনাপ্রবাহ প্রশ্ন তৈরি করেছে: উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে সঠিক তথ্য দিচ্ছেন? নাকি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে? নাকি সবাই মিলে দেশ ও জনগণের অতিগুরুত্তপুর্ন তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছেন যার কারনে একজনের সাথে আরেকজনের কথার মিল পাওয়া যাচ্ছেনা? রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর প্রকৃত অবস্থা এবং এতে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025, Jun 16