রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড ঘাটতির আশঙ্কা

চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে রেকর্ড ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের ঘোষিত বাজেটে যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার সেটি নামিয়ে এনেও আদায়ের লক্ষ্যাত্রার ধারেকাছেও যেতে পারছে না।

অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের হিসাব সেটি বিশ্লেষণ করে অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এর প্রতিক্রিয়ায় উন্নয়ন প্রকল্প কাঁটছাট, প্রকল্প বাতিল ছাড়াও সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সরকারি এ সংস্থাটি সংশোধিত লক্ষমাত্রা ৪ লক্ষ ৬৩ হাজার ৫শ কোটি টাকার বিপরীতে প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে চলতি জুন মাসে আদায় করতে হবে এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে ভাবছেন সংস্থাটির কর্মীরা।

সাধারণত এনবিআর প্রতি মাসে গড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করতে পারে। তবে বছরের শেষ মাসে সাধারণত কিছু বেশি অর্থ আদায় করা যায়। সে হিসেবে এনবিআর আশা করছে চলতি অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত তারা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে পারবে।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আদায়ের গতি চলতি মাসে অব্যাহত থাকলে এই বছর রাজস্ব ঘাটতি রেকর্ড পরিমাণে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো হতে পারে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সবশেষ বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের চতুর্থ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার সেই লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করে।

লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে থাকলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ মাসে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশ। এটিও অবশ্য গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমনকি করোনাভাইরাস মহামারীর বছর ২০২০-২১ অর্থবছরেও ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

প্রভাব কী হতে পারে

রাজস্ব আদায়ে বিপুল পরিমাণ ঘাটতির প্রভাব কী হতে পারে, এই প্রশ্নে অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে ঘাটতি মেটাতে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। এমনকি এর জন্য অনেক উন্নয়ন প্রকল্প কাঁটছাটও করতে হতে পারে।

কেন এই অবস্থা

২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের মন্দা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতা এবং ব্যাংক খাতের অস্থিরতাকে এ ঘাটতির পেছনে দায়ি করা হচ্ছে।

এই পিছিয়ে থাকার মধ্যেই আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা।

কর্মকর্তারা বলছেন, এই নতুন লক্ষ্যমাত্রাও বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কারণ যদি এ বছরের আদায় হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, তাহলে এনবিআরকে ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে জুনে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ সংস্থাটি মাসে আদায় করতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো।

এনবিআর এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর দুর্বল বাস্তবায়ন ও কাটছাঁটও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।”

অন্য একজন জ্যেষ্ঠ কর কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকগুলো বড় করদাতা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ বিষয়ে প্রভিশন সংক্রান্ত নীতিমালার কারণে তাদের লাভের হার কমে গেছে। এ কারণেও সরকার তুলনামূলক কম অর্থ পেয়েছে।

এই পিছিয়ে থাকার কারণ কী- এই প্রশ্নে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বছরের প্রথম প্রান্তিকে গণঅভ্যুত্থান এবং শেষ প্রান্তিকে এনবিআর কর্মীদের আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটেছে।

এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) সৈয়দ আমিনুল করিম মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে দেশের মানুষকে স্বস্তি দিতে অনেক পণ্যে কর ছাড় দিতে হয়েছে, এটিও রাজস্ব আদায়ে ঘাটতির একটি কারণ।

গত রোজায় নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভোজ্যতেলে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, আমদানি করা অনেক পণ্যে কর ছাড় বা শূন্য কর সুবিধাও দেওয়া হয়েছিল; ভোজ্যতেলের কর অব্যাহতি মেয়াদ শেষে আর বাড়ানো না হলেও অনেক নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে সর সুবিধা এখনও চালু আছে।

যত বেশি রাজস্ব আদায়ের তাগিদ

রাজস্ব আদায় পর্যালোচনা করতে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বৃহস্পতিবার। তিনি যতবেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করার ওপর জোর দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে টার্গেট ভিত্তিক রাজস্ব আদায় এবং বকেয়া আদায়ের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।

এনবিআর প্রধান জানান, রাজস্ব বেশি আদায় করা মানে দেশের ঋণ কমিয়ে আনতে সহায়তা করা। রাজস্ব আদায় বাড়াতে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করার ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

কোন খাত থেকে কত আদায়

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে শুল্ক কর বিভাগ থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ৯২ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরের একই সময় এখান থেকে আদায় হয়েছিল ৯১ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এ সময়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে আদায় হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল এক লাখ ১৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে আয়কর বিভাগ থেকে আয় হয়েছে এক লাখ ৭ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, যাগত বছর ছিল এক লাখ ৮৫৭ কোটি টাকা।

আদায় ‘সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম’

বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় কর আদায় অর্থাৎ কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে। সাম্প্রতিক সময়ে এ অনুপাত আরও কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অথচ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর কর-জিডিপি অনুপাত ১৯ শতাংশেরও বেশি।

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ ‘সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম’। এ কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন, পুঁজি গঠন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজস্ব আহরণ না বাড়ার কারণ কর ফাঁকি, কর ছাড়, কর আদায়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার ও পুরো প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা।

করদাতাদের আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবকেও বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদেরা। অনেকেই মনে করেন, তাদের পরিশোধিত কর যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। কর আদায়ে দুর্নীতি এবং কার্যকর পদ্ধতির অভাবও প্রক্রিয়াটি জটিল করেছে বলেও নানা সময় মত উঠে এসেছে।

করের আওতায় আসা উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা এখনও বাস্তবতার তুলনায় অনেক কম বলে সরকারের তরফেই বক্তব্য এসেছে। আয়করের বদলে ভ্যাট ও শুল্কের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা সুষম রাজস্ব প্রবাহের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করছে বলেও একাধিক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025