রাজনীতিতে এনসিপিকে প্রতিষ্ঠা করতে সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধযান ব্যবহার

‘মুজিববাদের কবর’ দিতে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ এ যাওয়া কিংস পার্টি এনসিপি ‘মুজিববাদকে রক্ষা’ করতে উন্মুখ বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েছিল। সরকার এই অনিবন্ধিত এনসিপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তাই তারা প্রথমে গুলি চালাল বেসামরিক মানুষদের ওপর, এরপর যুদ্ধযানের ভেতরে লুকিয়ে এনসিপি নেতাদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করল। এটা করা হলো সামরিক বাহিনীকে দিয়ে।

পুলিশ-সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে গোপালগঞ্জে নিহত হলো অন্তত ৪ জন। যদিও মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি আছে, তবু সরকারি ভাষ্যের ৪ জনকে আমলে নিলেও এই মৃত্যু উল্লেখের। গতরাতে (বৃহস্পতিবার) ঢাকা মেডিকেলে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।

বৃহস্পতিবার মারা যাওয়া লোকটি পেশায় রিকশাচালক। মারা যাওয়া আগের চারজনের মধ্যে রয়েছেন কাপড় ব্যবসায়ী ও শ্রমিক। অর্থাৎ এরা রাজনৈতিক কর্মী নন। স্রেফ বেসামরিক মানুষ। মৃতদের সবাই গুলিবিদ্ধ এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী যে গুলি চালিয়েছে, সেটা অস্বীকার করেনি।

সামরিক বাহিনীর কাজ বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রতিষ্ঠা করা নয়। কিন্তু অদ্য আমরা এটা দেখছি। প্রকাশ্যে তারা কিংস পার্টি এনসিপির হয়ে কাজ করছে, তারা এই দলটিকে পাহারা দিচ্ছে, এই দলের বিপক্ষে দাঁড়ানো বেসামরিক মানুষদের ওপর গুলি ছুঁড়ছে। ‘গুলি কর, গুলি কর; সরাসরি গুলি কর’, এমন আওয়াজও আমরা শুনেছি ভিডিওতে। যুদ্ধকালীন অবস্থা এবং একপাক্ষিক এটা; কারণ যুদ্ধযান, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের বিপরীতে অস্ত্রহীন সাধারণ মানুষ।

এই লেখায় যে ছবি সংযুক্ত করেছি, সেটা যুদ্ধংদেহী সেনাদের। যুদ্ধযান ও তাক করা প্রাণঘাতী অস্ত্র; পেছনে ধোয়ার কুণ্ডলী। যে কেউ এটাকে সিরিয়া-গাজা ভেবে ভুল করতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশেরই। ওখানে রাষ্ট্রীয় গৌরবের স্মারক, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছবি। তাদের কর্মকর্তারা তাদেরকে যাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের বেসামরিক মানুষ। এই বেসামরিক মানুষদের একটাই অপরাধ- তারা ‘মুজিববাদের সমর্থক, মুজিববাদের ধারক-বাহক’। আজ যে মুজিববাদকে কবর দেওয়ার মিশনে সহায়তা করতে নেমেছে সেনাবাহিনী, তাদের প্রতিষ্ঠাও হয়েছে এই মুজিববাদের মাধ্যমেই।

গোপালগঞ্জে যে সংঘাত হলো, একপাক্ষিক রক্ত ঝরল, তাতে যারাই নিহত হয়েছেন তারা বেসামরিক মানুষ। এটা কোনো দলের কর্মসূচি ছিল না। ছিল সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ। ওখানে কোনো দলের কোনো কর্মসূচি থাকলে সেটার রাজনৈতিক অর্থ থাকত, কিন্তু সে রকম কিছু ছিল না।

আইএসপিআর দাবি করেছে, আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি ছুঁড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোঁড়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেনি, পুলিশকে আক্রমণ করেনি। গোপালগঞ্জে জনসভাস্থলে গিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতার একাংশ তাদের ক্ষোভ ছড়িয়েছে সমাবেশ ভণ্ডুল করে দেওয়ার মাধ্যমে। এমনটা বাংলাদেশে আগে হয়নি এমন না, কিন্তু এটাকে মানুষ হত্যা করতে গুলি করার মতো পরিস্থিতি ছিল না।

এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যারাক ছেড়ে বাইরে থাকা সামরিক বাহিনীর ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতা তাদের থাকলেও গুলি করে মানুষ মারার মতো নিশ্চয়ই নয়। এখানে কি পুলিশ সদর দপ্তরের কন্ট্রোল রুমে বসা উপদেষ্টাদের দিকনির্দেশনা কাজ করেছে? তারা কি মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন? উপদেষ্টারা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন, এটা গোপনীয় থাকেনি। প্রকাশ্যে এক উপদেষ্টা ফেসবুকে এসে লিখেছেন— ***ভেঙে দিতে!

রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো গোপালগঞ্জে গুলি করে মানুষ মেরেছে। এখন দেখছি সেনাপ্রহরায় এনসিপি বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি পালন করছে। যুদ্ধযান নিয়ে যাচ্ছে এনসিপির কর্মসূচির নিরাপত্তা দিতে। এটা কী রকম পরিস্থিতি? রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী বিশেষ করে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর কাজ কি কোনো বিশেষ দলকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করা? তারা রাষ্ট্রের নাকি এনসিপির?

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কি কোনো নজির আছে- কোনো বিশেষ দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সেনাবাহিনী যুদ্ধযান নিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া? এটা কি তাদের ওজন-আবেদনের সঙ্গে মানানসই?

জুলাইয়ের আন্দোলন দিয়ে সরকার পরিবর্তনের পর এনসিপি সরকারি সহায়তায় গড়ে ওঠেছে। তাদের দলের কেউ কেউ তারা জুলাই আন্দোলনের সংগঠক ঠিক, কিন্তু তারা জুলাই আন্দোলনের একমাত্র স্টেক হোল্ডার নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ওই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। এছাড়া এনসিপি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদনের পর তারা দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলের মতোই একটা দল। এখানে যুদ্ধযান নিয়ে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সেনাদের নিয়োগ দেওয়া একদিকে যেমন সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করছে, অপরদিকে বাকি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি বৈষম্যও করা হচ্ছে।

এনসিপিকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সামরিক বাহিনীকে কেন দায়িত্ব দেওয়া হবে? তবে কি নির্বাচনের সময়েও তারা সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী থেকে বিশেষ আনুকূল্য পাবে?

অপরাপর রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপি স্রেফ আওয়ামী লীগ ও গোপালগঞ্জবাসীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কারণে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের বিষয়কে আমলে নিচ্ছে না। কিন্তু এটা সার্বক্ষণিক অনুশীলনের পর্যায়ে যে যাচ্ছে না, সেটা কীভাবে নিশ্চিত হবে তারা? একই পদ্ধতি অনুসরণ করে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীকে সরকার যদি এনসিপির পক্ষে কাজ করায়, তখন প্রতিবাদের সময় থাকবে তাদের?

একবার চিন্তা করে দেখুন, নির্বাচন হচ্ছে আর সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী এনসিপির পক্ষে ভোট দিতে উৎসাহিত করছে, এনসিপিকে ভোটের মাঠে, ফলাফলে সহায়তা করছে; মেনে নেবেন? না, মানতে চাইবেন না। কিন্তু এই পরিস্থিতি কি তৈরি করে দিচ্ছেন না আপনারা?

যুদ্ধযান নিয়ে এনসিপি জায়গায়-জায়গায় রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে- এর একটা অর্থ আছে। এটা একটা বার্তা দেয় মানুষকে। অস্ত্র দেখে মানুষ ভয় পায়, যুদ্ধযান দেখে মানুষের প্রাণ বায়ু উড়ে যেতে আকুলি-বিকুলি করে; এমন অবস্থায় মানুষ কি ভোটেকেন্দ্রে যাবে? কতজন যাবে? ভোটে যদি মানুষ না যায়, তবে বিজয়ী হয় অন্ধকারের আততায়ীরা। রাজনৈতিক ঐতিহ্য আছে যাদের, তারা অন্ধকারের আততায়ী নন, রাজনৈতিক মাঠ দখল করতে যুদ্ধে নামে যারা, তারাই অন্ধকারের আততায়ী। এই পামরদের হাতে দেশকে ছেড়ে দেওয়ার আগে অন্তত আওয়াজ তুলুন- রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো রাষ্ট্রের, অন্ধকারের আততায়ী-সন্ত্রাসী-জঙ্গিগোষ্ঠী ও বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত কারো নয়!

সময় থাকলে সাবধান না হলে পরে পস্তাতে হবে!

Tags :

Kabir Aahmed

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025