ভারতীয় পরিকাঠামোর এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি ভারত শাসিত কাশ্মীরে দুটি অত্যাধুনিক রেলওয়ে সেতুর উদ্বোধন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে চেনাব নদীর ওপর বিশ্বের সর্বোচ্চ সিঙ্গেল আর্চ রেলওয়ে সেতু এবং ভারতের প্রথম ক্যাবল স্টেইড রেলওয়ে সেতু, আঞ্জি খাদ ব্রিজ। এই যুগান্তকারী প্রকল্পগুলি কাশ্মীর উপত্যকাকে প্রথমবারের মতো ট্রেনের মাধ্যমে দেশের বাকি অংশের সাথে যুক্ত করে সংযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে।
জম্মু ও কাশ্মীরের রিয়াসি জেলায় চেনাব নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বের সর্বোচ্চ সিঙ্গেল আর্চ রেলওয়ে সেতু, চেনাব রেলওয়ে সেতু। অসাধারণ এই কাঠামোটি নদী থেকে ৩৫৯ মিটার (১,১৭৮ ফুট) উপরে অবস্থিত, যা ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ারের চেয়েও ৩৫ মিটার (১১৪ ফুট) বেশি উঁচু। ২২২ কিলোমিটার (১৬৯ মাইল) উদয়পুর-শ্রীনগর-বারামুলা রেল লিঙ্ক প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই বিশাল প্রকল্পটি নির্মাণে ভারতীয় রেলওয়ের দুই দশকের বেশি সময় লেগেছে।
বক্কল ও কৌরি গ্রামের মধ্যে ১,৩১৫ মিটার বিস্তৃত এই সেতুটি প্রকৌশলগত স্থিতিস্থাপকতার এক অনন্য উদাহরণ। ২৮,০০০ টনেরও বেশি ইস্পাত ব্যবহার করে নির্মিত এই সেতুটি ১২০ বছর টিকে থাকার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি ২৬৬ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাসের গতি এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনায়াসে সহ্য করতে সক্ষম। এর ৯৩টি ডেক সেগমেন্ট প্রতিটির ওজন প্রায় ৮৫ টন।
চ্যালেঞ্জ ও উদ্ভাবন: চেনাব সেতুর নির্মাণ কৌশল
চেনাব সেতু নির্মাণে প্রকৌশলীরা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স (IISc)-এর রক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ জি মাধবী লথা ঢালের স্থিতিশীলতা এবং ভিত্তি নকশার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি খননের সময় প্রাপ্ত ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণে একটি “নমনীয় নকশার” ওপর জোর দেন। এই উদ্ভাবনী পদ্ধতিই সেতুর সফল নির্মাণে সহায়ক হয়েছে।
এছাড়াও, প্রত্যন্ত অবস্থানের কারণে মূল নির্মাণ কাজ শুরুর আগে ২৬ কিলোমিটারের বেশি মোটরযোগ্য রাস্তা তৈরি করতে হয়েছে। চরম বৈরি আবহাওয়া এবং বারবার লজিস্টিক সংক্রান্ত বাধা অতিক্রম করে এই বিশ্বয় সেতুটি নির্মিত হয়েছে।
প্রথম ক্যাবল স্টেইড রেলওয়ে সেতু: আঞ্জি খাদ ব্রিজ
কাশ্মীরের পরিকাঠামো উন্নয়নে আরও একটি বড় ধাপ হিসেবে, প্রধানমন্ত্রী মোদি আঞ্জি খাদ ব্রিজ উদ্বোধন করেছেন। আঞ্জি নদীর ওপর নির্মিত এই সেতুটি ভারতের প্রথম ক্যাবল-স্টেইড রেলওয়ে সেতু যা চেনাব নদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনদীকেও সংযুক্ত করেছে।
এই অত্যাধুনিক সেতুটি অঞ্চলের রেল নেটওয়ার্ককে আরও শক্তিশালী করবে, যা স্থানীয়দের জন্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। জম্মু ও কাশ্মীর সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শ্রী মাতা বৈষ্ণো দেবী কাটরা এবং শ্রীনগরের মধ্যে নতুন বন্দে ভারত ট্রেন পরিষেবারও সূচনা করেন, যা যাত্রী সংযোগকে আরও সহজ এবং দ্রুত করবে। এই পদক্ষেপগুলি কাশ্মীরের পর্যটন ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ চেনাব সেতুর উদ্বোধনকে ঘিরে তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। উদ্বোধনের একদিন আগে সেতুটি পরিদর্শন করে তিনি ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার)-এ ছবি শেয়ার করেন। তিনি লেখেন, “আগামীকাল জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন, অবশেষে এই উপত্যকা দেশের বাকি অংশের সাথে একটি রেল সংযোগের মাধ্যমে যুক্ত হবে, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে উদ্বোধন করা হবে।”
এই সেতু নয় কাশ্মীর অঞ্চলের জন্য বিশাল আর্থ-সামাজিক সুবিধা নিয়ে আসবে। এটি সব ধরনের আবহাওয়ায় সংযোগ নিশ্চিত করবে। পর্যটনকে উৎসাহিত করবে এবং বাণিজ্য সহজ করবে। এটি কাশ্মীর উপত্যকাকে ভারতের জাতীয় কাঠামোর সাথে আরও নিবিড়ভাবে সংযুক্ত করবে। এই সেতু কাশ্মীরের উন্নয়নে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।