‘জুলাই আন্দোলনে’ পুলিশের উপর বর্বর আক্রমণ: মিডিয়া এবং মানবাধিকার সংস্থার নীরবতা

জুলাই আন্দোলন বা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর যে বর্বর হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে, তার বর্ণনা দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা কোনো মানবাধিকার সংস্থা বা আন্তর্জাতিক মিডিয়া এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে মারাত্মক রকমের দমন-পীড়নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা এমন কোনো খবর প্রকাশ করতে পারছে না, যা এই সরকারের বিপক্ষে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো বা সংস্থাগুলো কেন নীরব, তা একটি বড় প্রশ্ন।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর, এই হত্যাকাণ্ডগুলোর যাতে কোনো বিচার না হয়, সে ব্যাপারে একটি ইনডেমনিটি আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক শতাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের তথ্য সংগ্রহ এখনো জারি আছে এবং সম্পূর্ণ অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হবে। আজ আমরা সেই ভয়াবহ বর্বরতার কিছু স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ২৬টি ঘটনা তুলে ধরছি। উল্লেখ্য যে, আমাদের কাছে থাকা অনেক ছবিই প্রকাশ করার মতো নয়।

আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এই জনপদ নরম পলিমাটির তৈরি, এখানে মানুষ সরল জীবন যাপন করে। এটি বাউলের দেশ, চাষিদের দেশ। এই অঞ্চলের মানুষ হিংস্র বা বর্বর নয়। কিন্তু আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর এবং দেশের সম্পদের ওপর এমন বর্বরতা চালানো মানুষগুলো কি আমাদের অজানা? একটি নির্দিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী কি বারবার একই ধরনের বর্বরতা চালাচ্ছে না? পুলিশের ওপর এমন আক্রমণ আমরা জামায়াত-শিবিরের আন্দোলনের সময়ও বাংলাদেশে দেখেছি।

জামায়াতের নায়েবে আমিরসহ বিভিন্ন নেতাকর্মী প্রকাশ্যে আন্দোলনের নামে তাদের ছলচাতুরীর কথা বলছেন। এমনকি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তাদের সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করার মাস্টার প্ল্যানের কথা বলেছেন। সেই একই উপদেষ্টা রাইফেলের গুলি এবং ম্যাগাজিন নিয়ে বিদেশ যাত্রার সময় ধরা পড়েন যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়, কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা সরকার পক্ষ থেকে নিতে দেখা যায়নি।

আন্দোলনের সময় অনেক নিরীহ মানুষও নিহত হয়েছেন, যা কেবল পুলিশ প্রশাসনের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনা হিসেবে অনবরত প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো সুষ্ঠু বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পুলিশ আক্রমণ করেছিল বলে ঢালাও প্রচার করা হলেও, পুলিশ কোন পরিস্থিতিতে আক্রমণ করেছিল, তা যেন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে, সে ব্যাপারে বর্তমান সরকার এবং তাদের সুবিধাভোগীরা পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেনকে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই তিনি “জুলাই বিপ্লব” নামে পরিচিত ছাত্র আন্দোলনের সময় ঘটে যাওয়া হতাহতের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন।

তিনি বলেছিলেন যে মৃতদের বেশিরভাগের শরীরে ৭.৬২ মিমি-এর বুলেট পাওয়া গেছে। তিনি জোর দিয়েছিলেন যে “একটি বড় ধরনের তদন্ত প্রয়োজন” এটি খুঁজে বের করার জন্য যে এই ধরনের নিষিদ্ধ অস্ত্র বা গুলি কীভাবে এবং কারা ব্যবহার করলো।

মিডিয়াতে এই বক্তব্য পেশের কয়েক দিনের মধ্যেই, ১৬ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে বদলি করা হয়। নতুন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে। পরবর্তীতে, ১০ নভেম্বর, ২০২৪ তারিখে তাকে পুনরায় বদলি করা হয় এবং তাকে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বদলি প্রসঙ্গে এম. সাখাওয়াত হোসেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলেন যে এতে তার “মন খারাপের কিছু নেই”। তিনি বলেন, “আমার যতটুকু করার সাধ্য ছিল, করে আসছি।”

ঘটনাগুলোর বিবরণ:

১৯ জুলাই, ২০২৪, সকাল ৮:০০, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী: কোটা আন্দোলনের সময় বিএনপি, ছাত্রদল, জামায়াত-ই-ইসলামী নেতা ও কর্মী এবং অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের দ্বারা যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করা হয়। তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর, নায়েক গিয়াস উদ্দিন এবং সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মোহাম্মদ মোক্তাদিরকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে তাদের মরদেহ ফুট-ওভার ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

৪ আগস্ট, ২০২৪, রাত ৯:০০, এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার নিরস্ত্র পরিদর্শক মো. আবদুর রাজ্জাককে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী এবং বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের দ্বারা থানার ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

৪ আগস্ট, ২০২৪, রাত ৯:০০, এনায়েতপুর, সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার নিরস্ত্র উপ-পরিদর্শক মো. রইস উদ্দিন খানকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী এবং বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের দ্বারা থানার ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, রাত ১০:০০, বাইপাইল, আশুলিয়া: ঢাকার বিশেষ শাখা (এসবি)-এর সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রফিকুল ইসলামকে আশুলিয়ার বাইপাইল মসজিদের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:৩০, উত্তরা পূর্ব থানা, ঢাকা: গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রাশেদুল ইসলামকে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:৩০, যাত্রাবাড়ী থানা, ঢাকা: উপ-পরিদর্শক শ্রী সুজন চন্দ্র দে-কে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দুর্বৃত্তদের হামলায় হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:৩০, যাত্রাবাড়ী থানা, ঢাকা: যাত্রাবাড়ী থানার কনস্টেবল মো. আবদুল মাজিদকে থানার সামনে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:৩০, যাত্রাবাড়ী থানা, ঢাকা: কনস্টেবল মো. রেজাউল করিমকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:০০, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, ঢাকা: পিওএম পশ্চিম বিভাগের কনস্টেবল মো. মাহফুজুর রহমানকে জাতীয় সংসদ ভবনের কাছে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:০০, উত্তরা পূর্ব থানা, ঢাকা: ট্রাফিক উত্তর বিভাগের কনস্টেবল মো. শহিদুল আলমকে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে কোটা আন্দোলনকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৫:৩০, উত্তরা পূর্ব থানা, ঢাকা: পুলিশ কল্যাণ ফোর্সের কনস্টেবল মো. আবু হাসনাত রনিকে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীদের হামলায় উত্তরা পূর্ব থানার সামনে হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৫:৩০, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, ঢাকা: কদমতলী থানার কনস্টেবল মীর মমতাজ আলীকে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীদের দ্বারা জাতীয় সংসদ ভবনের কাছে হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, বিকাল ৪:৩০, বাসন থানা, গাজীপুর: গাজীপুর শহরের বাসন থানার সামনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের দ্বারা কনস্টেবল মো. আবদুল মালেককে হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, বিকাল ৪:৩০, আশুলিয়া, ঢাকা: ঢাকা জেলা পুলিশের উপ-পরিদর্শক মো. সোহেল রানাকে আশুলিয়ার আফসার মলের বাড়ির সামনে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা হত্যা করে।

৫ আগস্ট, ২০২৪, বিকাল ৪:৩০, আশুলিয়া, ঢাকা: ঢাকা জেলা পুলিশের উপ-পরিদর্শক রাজু আহমেদকে আশুলিয়ার আফসার মলের বাড়ির সামনে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা হত্যা করে।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭:০০, উত্তরা পূর্ব থানা, ঢাকা: পিওএম দক্ষিণ বিভাগের কনস্টেবল মো. সুজন মিয়াকে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীদের হামলায় উত্তরা পূর্ব থানার সামনে হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, উত্তরা পূর্ব থানা, ঢাকা: উপ-পরিদর্শক খগেন্দ্র চন্দ্র সরকারকে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা উত্তরা পূর্ব থানার সামনে হত্যা করে।

৫ আগস্ট, ২০২৪, যাত্রাবাড়ী থানা, ঢাকা: সহকারী উপ-পরিদর্শক সঞ্জয় কুমার দাসকে কোটা আন্দোলনকারীদের হামলায় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, যাত্রাবাড়ী থানা, ঢাকা: কদমতলী থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক ফিরোজ হোসেনকে বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা যাত্রাবাড়ী থানার সামনে হত্যা করে।

১৪ আগস্ট, ২০২৪, রাত ২:০০, শ্যামপুর থানা, ঢাকা: শ্যামপুর থানার কনস্টেবল মো. খলিলুর রহমানকে থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৬:৩০, কচুয়া, চাঁদপুর: চাঁদপুরের কচুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রশিদকে কচুয়া বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের সামনে উত্তেজিত জনতা পিটিয়ে হত্যা করে।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৫:৩০, সোনাইমুড়ি, নোয়াখালী: নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি থানার চার পুলিশ সদস্য—সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. নাসির, এসআই মো. বশির, কনস্টেবল মোশাররফ এবং গিয়াসকে উত্তেজিত জনতা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

৫ আগস্ট, ২০২৪, রাত ১১:৩০, তিতাস, কুমিল্লা: কুমিল্লার তিতাস থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম এবং কনস্টেবল মইন উদ্দিন এবং দাউদকান্দির তুজারভাঙ্গা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা বাবু মিয়াকে উত্তেজিত জনতা হত্যা করে।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭:৩০, সোনাইমুড়ি, নোয়াখালী: নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ বশির এবং একজন কনস্টেবলকে উত্তেজিত জনতার হামলায় হত্যা করা হয় এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরীর হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়।

৫ আগস্ট, ২০২৪, সন্ধ্যা ৭:৩০, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার সহকারী শহর উপ-পরিদর্শক (এএটিএসআই) আলী হোসেন চৌধুরীকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

১৪ আগস্ট, ২০২৪, রাত ২:০০, শ্যামপুর থানা, ঢাকা: শ্যামপুর থানার কনস্টেবল মো. খলিলুর রহমানকে থানার সামনে বিক্ষোভকারীদের হামলায় হত্যা করা হয়।

Tags :

Anis Abrar

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025