জেনারেল ওসমানীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিতি: মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাছে খোলা চিঠি

জনাব ফারুকী সাহেব, আপনি সংস্কৃতি উপদেষ্টা, মন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ আমাদের দেশে লেখাপড়া জানা লোক হয় না তেমন একটা। দুই একটা বেতিক্রম ছাড়া। মানে একাডেমি অর্থে বুঝাই নাই, তাদের ইতিহাস দর্শন সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান নিয়ে আমার ধারণা ভালো না। তবে সংস্কৃতি জগতের লোকজনের এইসব লেখাপড়া জানা খুব জরুরী। কারণ তারা ভুলভাল ইতিহাস জানলে জনসাধারণের ক্ষতি। মাস ছয়েক আগেও আপনি সেই কাজটি করেছিলেন, আমাদের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করেছিলেন, তখনো আমি সেটা নিয়ে লিখেছিলাম। তবু দেখলাম আপনি সেই একই কাজ করে যাচ্ছেন এবং জাতির স্বীকৃত ইতিহাস নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে কমেন্ট সেকশন বন্ধ বন্ধ করে রাখলে আপনাকে সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানানো সম্ভবপর নয়। তাই এই খোলা চিঠি লিখতে হলো। আশা করি উদার মন নিয়ে আপনি চিঠিটা (যদি আপনার শুভাকাঙ্খি কেউ পড়ায়) গ্রহণ করবেন।

আপনি জেনারেল ওসামানীকে সম্মান জানাতে গিয়ে কিছু কথা বলেছেন আপনার ফেইসবুক পোস্টে। আপনি এদেশের বুদ্ধিজীবীদের খোঁচা দিয়ে বলেছেন, এদেশের ইন্টেলিজেন্সিয়া জিয়া ও ওসমানী সাহেবকে সেলিব্রেট করেন না। তারপর বলেছেন, যারা মাঠে যুদ্ধটা করলো, যুদ্ধের ঘোষণা দিলো তাদেরকে আমাদের ইতিহাসের পাতা থেকে দূরে অথবা কম আলোকিত করে রাখা হয়েছে। আপনার এই কথায় খুবই হাস্যকর একটা ইঙ্গিত দেখতে পাওয়া যায়। “যারা মাঠে যুদ্ধ করলো” এই খোঁচাটা কি শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনদের ঘিরে দিলেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি স্টালিন, রুজভেল্ট, চার্চিল নিজেরা মাঠে গিয়ে যুদ্ধটা করেছিলেন? আপনি এখনো মধ্যযুগের রাজাদের যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি? আধুনিককালের যুদ্ধে নেতারা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তারা কেউ অস্ত্র চালাতেই জানেন না। আর মাঠে গিয়ে যদি যুদ্ধের কথাই বলেন, জনাব ফারুকী, জিয়াউর রহমান বা ওসমানী কেউ মাঠে গিয়ে যুদ্ধ করেন নাই! কোন সেক্টর কমান্ডারই মাঠে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন নাই! ফলে সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের পদক দেয়ার সময় জিয়াউর রহমানসহ সেক্টর কমান্ডারদের বীর উত্তম দেয়ায় খোদ সেনাবাহিনী থেকেই আপত্তি এসেছিল যে, যারা সম্মুখ যুদ্ধে কোন বীরত্ব দেখান নাই তাদের কেন বীর উত্তম দেওয়া হলো? সেক্টর কামান্ডাররা কেবল যুদ্ধ ট্রেনিং ও যুদ্ধের অপারেশনের পরিকল্পনা করেছিলেন ভারতের মাটিতে বসে। সেই যুদ্ধ পরিকল্পনাটাও হয়েছিল ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে! মুক্তিযুদ্ধ থেকে ভারতে কি করে আলাদা করবেন, বলুন?

আর হ্যাঁ, জিয়াউর রহমান বলেন বা ওসমানী, তারা সকলেই মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী ছিলেন! যুদ্ধের ঘোষণা দেয়ার, স্বাধীনতার ডাক দেয়ার কোন রাইট তাদের নাই। তারা কোনদিন সে দাবী করেনও নাই। যুদ্ধটা হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারের পরিচালনায়।

জনাব ফারুকী, এরপর আপনি ভয়ংকর একটা বিতর্ক তুলেছেন যা এদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্ত করবে। ঘটনা সত্যি হলে আমার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু আপনি একদমই জামাত শিবিরের প্রোপাগন্ডা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আছেন। আপনি ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘আমাদের ইতিহাসের ওই ক্রিটিক্যাল প্রশ্নগুলো অ্যাড্রেস করা হয়নাই যে, যুদ্ধ চলাকালীন ওসমানীর বক্তব্য কী ছিল। ওনার কি কোনো বিষয়ে ভিন্নমত ছিল? ১৬ ডিসেম্বর তিনি কেন হাজির ছিলেন না? মুক্তিবাহিনী অথবা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে কেন ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করানো হলো? সময় এসেছে এ রকম সব প্রশ্ন তোলার। শুধু প্রশ্নই না, এই বিষয়ে ইতিহাসের সত‍্যগুলোও নির্মোহভাবে তুলে ধরার।’

জনাব ফারুকী, ওসমানী সাহেব বেঁচে থাকলে আপনাকে আজকে আরেকটা ধমক দিতেন কারণ এই বিতর্ক মুজিবনগর সরকারের কারোর কারোর মুখে উঠলে তিনি সেদিন ধমকে উঠেছিলেন। সেদিন আপনার মতই যাদের এইসব প্রশ্ন মাথায় এসেছিল ওসমানী সাহেব তাদের কি জবাব দিয়েছিলেন সেটা সরাসরি তুলে ধরছি। একটু পড়ে দেখবেন-

মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের মুক্তিবাহিনীর সদরদফতরের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন নজরুল ইসলাম। তিনি তার বই “একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা”-তে লিখেছেন, “পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্ব শেষ হওয়ার দুদিন পর জেনারেল ওসমানী বিক্ষুব্ধ-উত্তপ্ত মুজিবনগর সরকারের সদর দফতরে ফিরে আসেন। ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তার অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষোভ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টির হয়, যা মুজিবনগর সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ সময়ে মুজিবনগরে জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা সরকারের নেতারাও তার ওপরে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা সরকারের সদর দফতরে পা রেখে জেনারেল ওসমানী উত্তাপ কিছুটা টের পেয়েছিলেন।”

“… জেনারেল ওসমানীর এডিসি সবিস্তারে জেনারেল সাহেবের অনুপস্থিতিতে তাকে ঘিরে কে কী মন্তব্য করেছেন, সব কথা তাকে রিপোর্ট করেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে আরও অবহিত হওয়ার জন্য জেনারেল সাহেব আমাকে তার কক্ষে ডাকেন। খুব ধীরস্থির হয়ে বসে জেনারেল ওসমানীকে জানালাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আপনার অনুপস্থিতি নিয়ে এখানে রাজনৈতিক মহলে বিরূপ সমালোচনা হয়েছে।”

“জেনারেল ওসমানী কিছুটা কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনও চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনও সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে, আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।”

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী (মাঝে) ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করছেন।

নজরুল ইসলাম এরপর লিখেন ওসমানী সাহেবের আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠানে যাবার কোন সুযোগ ছিল না আর্মি প্রটোকল হিসেবে। জেনারেল ওসমানী তাকে বলেন, “নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল শ্যাম মানেকশ। সত্যি কথা আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনও নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ, বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনও দেশ নয়। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে আমার যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশের সমান। সেখানে জেনারেল মানেকশের অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়, এটা প্রটোকলের ব্যাপার।…প্রটোকল সম্পর্কে আমাদের লোকদের কোনও ধারণা নেই, তাই এত ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি। লোকজনকে বুঝিয়ে বলুন।”

এই কথোপকথনের সময় সিলেটের আওয়ামী লীগের নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী ওসমানীর ঘরে ঢুকে বলেন, “পিআরও (নজরুল ইসলাম) সাহেব ঠিকই কইছুন। মানুষ চায় পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করুক।” জবাবে বিরক্ত হয়ে ওসমানী বলেন, “তোমরা লোকজনকে অন্ধকারে রেখেছো। দুনিয়ার রীতিনীতি সম্পর্কে মানুষকে কিছু জানতে দাও। যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-পরাজয়, আত্মসমর্পণ সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশনের আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে। জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-পরাজয়, আত্মসমর্পণ ইত্যাদির ব্যাপারে এ নীতিমালা মানতে বাধ্য। আমরা মানে বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নই। এই কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হবে না। কারণ, তাদের (পাক বাহিনী) ধারণা, আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে আমরা তাদের সঙ্গে জেনেভা কনভেনশনে বর্নিত নীতিমালা অনুযায়ী আচরণ করবো না। যেহেতু আমরা জেনেভা কনভেনশনের আওতায় পড়ি না, তাই জেনেভা কনভেনশনের নীতিমালা মানতে আমরা বাধ্যও নই। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হত্যা করে ফেলবে। কিন্তু জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী পরাজিত আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের হত্যা করা বা কোনও রূপ নির্যাতন করা যায় না। তাদের নিরাপত্তায় আইনি প্রটেকশন দিতে হয়। সামরিক রীতিনীতি অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করতে হয়। উন্নত খাবার, নানান সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। বন্দিকালীন সময়ে নিরস্ত্র অবস্থায় এক্সারসাইজ, খেলাধুলা ইত্যাদির সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়। কিন্তু আমরা তো এখনও ভারতের মাটিতেই রয়ে গেছি। বাংলাদেশই তো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমাদের সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কোনও নিয়মিত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী নেই। এমনকি পুলিশ বাহিনীও নেই। এ অবস্থায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমরা তাদের রাখবো কোথায়? তাদের প্রটেকশন দেবো কিভাবে? ৯০ হাজার সৈন্যকে তিন বেলা উন্নত খাবার দেবো কোথা থেকে। দেশে গিয়ে তো আমরাই খাবার পাবো না।” (একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা, নজরুল ইসলাম, পৃষ্ঠা ২৪২-২৪৬)

জনাব ফারুকী, আমাদের নাটক সিনেমা জগতের লোকজনের অন্তত নিজেদের দেশের ইতিহাসটা ভালো মত পড়া থাকা দরকার। একটা কালচারাল অশিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ যদি দেশের সংস্কৃতি জগতের কল্কে পায় সেটি জাতির জন্য ভালো নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ছিনতাই করে নিয়েছিল, তারা ক্রেডিট নিয়ে নিয়েছে এসব বলে বিভ্রান্ত করা যাবে কিছু সময়ের জন্য, কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম যতটুকু ইতিহাস লিখে গেছে সেটাই যথেষ্ঠ মিথ্যাকে পরাজিত করতে। ধন্যবাদ।

সুষুপ্ত পাঠক

Tags :

Susupto Pathok

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025