গত ১০ মাসে (জুলাই ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে কোনো সুসংবাদ নেই। সরকার পরিবর্তনের পর এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হলেও বাস্তবে তার উল্টো চিত্রই প্রকাশ পাচ্ছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ক্যালেন্ডার বছরে বাংলাদেশে নিট সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) এসেছে মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫% কম। এটি গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। (সূত্র: The Daily Star, 2025)
এই বিনিয়োগ হ্রাসের পেছনে রয়েছে একাধিক গভীর ও গঠনতান্ত্রিক সমস্যা। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক নাটকীয়তার পর দেশ যে পথে এগিয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথ নয় বরং তাৎক্ষণিক আর অন্তর্বর্তী ব্যাখ্যার মধ্যে আটকে আছে। ‘নিরপেক্ষ সরকার’ ও ‘অরাজনৈতিক প্রশাসন’ নামধারী কাঠামো একদিকে যেমন প্রশাসনিক জবাবদিহিতা হ্রাস করেছে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের মনে তৈরি করেছে আস্থাহীনতা।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বর্তমানে বিনিয়োগহীনতার প্রধান কারণ। যখন একটি দেশের সরকার অস্থায়ী, সীমিত সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে পরিচালিত এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত—তখন কোনও আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দেশই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করতে চায় না। Uncertainty aversion বিনিয়োগ তত্ত্বে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। ইউনূস স্যার নিজে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব হলেও তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারকে এখনো অনেকে ‘অনির্বাচিত’, ‘অস্থায়ী’ এবং ‘পলিটিক্যালি টেন্টেটিভ’ বলে গণ্য করছে। ফলে, অনেক চুক্তিই থমকে আছে।
এছাড়া নীতিগত অস্থিরতাও বিনিয়োগ হ্রাসের আরেক কারণ। কিছুদিন আগে একটি আইটি কোম্পানির প্রতিনিধি বলেছেন, “বাংলাদেশে নিয়মনীতি প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে, কোনো ফিসক্যাল স্ট্যাবিলিটি নেই—এমন দেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।”
অন্যদিকে, দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোও আশঙ্কাজনকভাবে দুর্বল। মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো অনিশ্চিত অবস্থায়, এবং ডলারের ঘাটতির কারণে আমদানি খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এসবের যোগফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা স্পষ্ট।
ইউনূস সরকার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বক্তৃতা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন—এটি তাঁর সদিচ্ছার প্রমাণ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা শুধু সদিচ্ছায় বিশ্বাস রাখে না, তারা চায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতির ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির নিশ্চয়তা—যা অস্থায়ী সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এখনও বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগের বিষয়ে সরাসরি প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে ইউনূস স্যারের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিষয়টা যেন তেমন—একজন দক্ষ নাবিক ঝড়ের মধ্যে পড়ে দিশাহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, পেছনে শক্তিশালী ভেনচারের পতাকাবাহী জাহাজ, কিন্তু সামনে দিগন্তজোড়া কুয়াশা। বহু দেশ ও সংস্থাই অস্থায়ী ও নির্বাচিত নয় এমন কাঠামোর সঙ্গে বড় চুক্তিতে যেতে চায় না। বিনিয়োগকারীদের জন্য সময়, স্থিতি ও স্থায়িত্ব—এই ত্রয়ী ছাড়া বাজারে প্রবেশ করা মানে খরায় বীজ বোনা।
অর্থনীতির ভেতরে আরেক স্তরেও চাপ ক্রমেই বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি, ডলারের রিজার্ভ সংকট, আমদানি বাধা—সব মিলিয়ে দেশের বাজার যেন এক বিকল ইঞ্জিন, চালু করতে গেলে শুধুই কাঁপুনি কিন্তু গতি নেই। এমন বাস্তবতায় ইউনূস সরকারের নীতি-পরিকল্পনা শুধু শব্দে উচ্চারিত হচ্ছে, বাস্তবায়নের মাটি খুঁজে পাচ্ছে না।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতি এক ধরনের স্থবিরতায় পড়েছে। ইউনূস স্যারের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্বাচনী ও সাংবিধানিক ম্যান্ডেট পায়, ততক্ষণ পর্যন্ত এই বিনিয়োগ-শূন্যতা চলতেই থাকবে।
তথ্যসূত্র:
১। The Daily Star: FDI slipped to five-year low in 2024
২। Bangladesh Bank FDI Data: BB Annual FDI Survey 2024
৩। AP News: European Investment Bank’s cautious stance on Bangladesh
৪। Reuters: China-Bangladesh investment dialogue
এনামুল হক
কলামিস্ট, কথা সাহিত্যিক, পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট।