অপসারণ করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন

সিলেট মহানগরীর কেন্দ্রস্থলে চৌহাট্টার এক পাশে সীমানাপ্রাচীর বেষ্টিত খোলা পরিসরে আবাসিক এলাকা। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের পুরাতন ক্যাম্পাস। এখন ব্যবহৃত হচ্ছে মেডিকেলের হোস্টেল হিসেবে। সেখানকার ঘরগুলো সব বিশেষ বৈশিষ্ট্যের। দেখামাত্র হারানো দিনের দিকে ধাবিত করে দর্শনার্থীদের। এসব স্থান ও স্থাপনার মধ্যে আছে যুদ্ধস্মৃতিও। মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীর অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি পর্ব এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের এখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘সামরিক ব্যারাক’ সংস্কৃতির সূত্রপাত হয়েছিল সেখান থেকে। এক স্থানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহন করায় স্থপতির চোখে পুরো আবাসিক এলাকা যুদ্ধস্মৃতির। কিন্তু স্মৃতিবাহী স্থাপনাটি আর থাকছে না। পুরোনো ও জরাজীর্ণ হওয়ায় স্থাপনাগুলো অপসারণে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সিলেটের একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে উন্মুক্ত নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের প্রশাসনিক দপ্তরে যোগাযোগ করে বিজ্ঞপ্তি জারির বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ১৯টি হোস্টেলের ভবন নির্মাণ প্রকল্পে সেখানকার ৪১টি গাছ অপসারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বানের কথা বলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিলাম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দেশের ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ১৯টি হোস্টেল নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরবর্তী প্রক্রিয়ায় ভাঙারির মাধ্যমে স্থাপনা অপসারণ করা হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তার দপ্তর থেকে বলা হয়, কলেজ অধ্যক্ষ নয়, প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে। তবে কলেজ অধ্যক্ষ প্রকল্পসংশ্লিষ্ট বলে সূত্র নিশ্চিত করলেও কলেজ প্রশাসন থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ সিলেট বিভাগে প্রথম সরকারি মেডিকেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল স্কুল ১৯৬২ সালে হয় সিলেট মেডিকেল কলেজ এবং ১৯৮৬ সালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে রূপান্তর করা হয়। মেডিকেল কলেজের পুরাতন ও নতুন ক্যাম্পাস নামে দুটি এলাকাতেই শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসস্থল। আবাসস্থলের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টার আর ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসস্থল হোস্টেল বা ছাত্রাবাস, ছাত্রীনিবাস নামে পরিচিত।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, মেডিকেলের পুরাতন ক্যাম্পাস ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বকালীন প্রতিষ্ঠিত হয়। জার্মান সৈন্যদের ব্যারাক হিসেবে গড়ে ওঠা স্থাপনাটিই মুক্তিযুদ্ধে শহিদ চিকিৎসক ডা. সামসুদ্দিন আহমেদ ছাত্রাবাস নামে পরিচিত। স্থাপনার বয়স ৮৫ বছর।

শহিদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদ (১৯২০–১৯৭১) সিলেটের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহিদ হন। তার নামেই পরবর্তী সমেয় সিলেট সদর হাসপাতাল ও ছাত্রাবাস নামকরণ হয়। স্থাপনা ঘিরে দুই যুদ্ধের স্মৃতি তর্পণ তখন থেকে শুরু হয়। স্থাপনা স্থাপত্য নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সিলেটে মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণের জন্য হাসপাতাল ও সংলগ্ন ছাত্রাবাস (হোস্টেল) নির্মাণ শুরু হয়। ভবনগুলো নির্মাণে তৎকালীন ‘আসাম প্যাটার্ন আর্কিটেকচার’ অনুসরণ করা হয়। এর মধ্যে উঁচু ছাদ, লম্বা বারান্দা, ঢালু ছাদ, কাঠ ও ইটের সমন্বিত নির্মাণকৌশল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ১৯৩৬-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ভবনটি সিলেট সদর হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৪৮ সালে সিলেট মেডিকেল স্কুল স্থাপিত হলে এটি ছাত্রাবাস ও হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৬২ সালে সিলেট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই ছাত্রাবাস কলেজ শিক্ষার্থীদের মূল হোস্টেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সিলেটের ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য হেরিটেজ’-এর তথ্যানুসন্ধান বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হোস্টেলের ইতিহাস (সামরিক ব্যারাক হিসেবে) তথ্য থেকে জানা গেছে, ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার আসাম ও সিলেট অঞ্চলে সামরিক গুরুত্ব আরোপ করে। সিলেট ছিল আসাম সীমান্তবর্তী একটি কৌশলগত নগরী; বিমানঘাঁটি ও সৈন্য চলাচলের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪২ সালে জাপানি সেনারা মায়ানমারের (বার্মা) দিক থেকে অগ্রসর হলে ব্রিটিশরা সিলেট অঞ্চলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে। এ সময়ে সিলেট শহরের অনেক বড় সরকারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন, বিশেষ করে মেডিকেল ছাত্রাবাস ও হাসপাতালের অংশবিশেষ, ‘সামরিক ব্যারাক’ হিসেবে দখল নেওয়া হয়। বর্তমান শহিদ শামসুদ্দিন হোস্টেলটি সেই সময় ব্রিটিশ সেনাদের অস্থায়ী আবাস ও চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভবনটির অবস্থান শহরের কেন্দ্রস্থলে হওয়ায় এটি সৈন্যদের থাকার স্থান, ছোটখাটো চিকিৎসা ইউনিট এবং সরঞ্জাম মজুদের জন্য ব্যবহার করা হতো। স্থানীয় মানুষজনের প্রবেশ সীমিত করা হয়েছিল এবং পুরো এলাকা ছিল সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে (১৯৪৫ সালের পর) ব্রিটিশ সেনারা ভবন খালি করে দেন। পরবর্তীতে এটি আবার সাধারণ হাসপাতাল ও ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়।

‘সেভ দ্য হেরিটেজ’-এর প্রধান নির্বাহী আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, ‘মেডিকেল ও স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের গবেষণা তথ্য থেকে জানা গেছে ছাত্রাবাসটি দুটো যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এটি মিলিটারি ব্যারাক সংস্কৃতির একমাত্র চিহ্ন। আর মুক্তিযুদ্ধে এখান থেকে সংগঠিত হওয়ার তথ্যাবলীও রয়েছে। আমাদের স্থাপত্য ঐতিহ্যের আসামবাড়ি কাঠামো সরকারি স্থাপনার মধ্যে টিকে থাকারও একটি নিদর্শন। এটি এভাবে ভাঙা হলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আসামবাড়ি সুরক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

স্থাপনা ও স্থাপত্য রক্ষা করে সংস্কার সম্ভব বলে জানিয়েছেন স্থপতি রাজন দাশ। তিনি বলেন, ‘ওই স্থানটি স্থাপত্যকর্মের অনন্য এক নিদর্শন। জার্মান থেকে একদল স্থপতির সঙ্গে ওই এলাকা ঘুরেছি। তারা এসব সংস্কারের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে জানিয়েছেন। আমিও দেখেছি। ছাত্রাবাসের আসাম কাঠামোর সবকটি ঘর সংস্কার করে রক্ষা সম্ভব। এসব কাঠামো এতই বিরল ও বিস্ময়কর যে, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি একাকার হয়েছে। যেমন, প্রতিটি ঘর উত্তর-দক্ষিণমুখো। রয়েছে উঠোন, সুপরিসর বারান্দা। জানালাগুলোও হাই-উইন্ডো। বাংলাদেশের প্রকৃতির সঙ্গে ব্রিটিশ নির্মাণশৈলীর চমৎকার মিশেল এখানে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যা হারালে একেবারেই হারিয়ে যাবে। স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতো।’

সূত্র : খবরের কাগজ

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025