অন্তর্বর্তী সরকারের দশ মাসে বেহাল পুঁজিবাজার

দীর্ঘদিন ধরে দেশের পুঁজিবাজারের অবস্থা বেহাল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১০ মাস পুঁজিবাজারে কোনো নতুন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) অনুমোদন হয়নি। যদিও আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সূচকের সাময়িক উত্থান হয়েছিল।

তবে সরকার বদলের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নেতৃত্বের বদল হলেও বাজারে কোনো আশার আলো দেখা যায়নি। বিদ্যমান সংকটেরও যেন কোনো সমাধান নেই। এ কারণে বাজার কেবলই দরপতনের একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।

গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পুঁজিবাজারের হাল ধরেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। ওইদিন ডিএসইর প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৭৭৫.৪৯ পয়েন্টে।

তিনি কাজে যোগ দেওয়ার ১০ মাস হলেও পুঁজিবাজারে গতিশীলতা ফিরে আসেনি। বরং বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা বেড়েছে। বাজারের লেনদেন তলানিতে নামা, বড় অঙ্কের সূচকের পতন ঘটা থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারীদের জন্য হতাশার সময় কাটছে। এর মধ্যে নতুন করে কম্পানি পুঁজিবাজারে না আসা যোগ করেছে হতাশার নতুন মাত্রা।

খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত একটিও আইপিও অনুমোদন করা হয়নি। বরং এ সময়ে বাতিল করা হয়েছে ১৭টি কোম্পানির আইপিও আবেদন, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে নজিরবিহীন।

বিএসইসি ও ইস্যু ম্যানেজার সূত্রগুলো বলছে, গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজার থেকে উদ্যোক্তারা যেভাবে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন, তা দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশেষ করে ২০১৯-২০২৩ সময়ে অনেক কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে বড় অঙ্কের পুঁজি সংগ্রহ করে। কিন্তু ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ২০২৪ সালের মাঝামাঝি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রবাহ একেবারেই থেমে যায়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে পুঁজিবাজার থেকে এক টাকাও সংগ্রহ করতে পারেনি কোনো কম্পানি।

আইপিও না এলে কী হয়

পুঁজিবাজারের যে দুটি অবস্থান অর্থাৎ প্রাথমিক পুঁজিবাজার এবং দ্বিতীয় স্তরের পুঁজিবাজার, উভয় খাতেই মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রাথমিক পুঁজিবাজার মূলত এমন একটি অবস্থান, যেখান থেকে আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানি মূলধন সংগ্রহের সুযোগ পায়। একটি লিমিটেড কোম্পানি যে পদ্ধতিতে প্রথমেই জনগণের মাঝে শেয়ার বিক্রি করে প্রাথমিক মূলধন সংগ্রহ করে, সেটিই হচ্ছে প্রাথমিক পুঁজিবাজার বা প্রাইমারি মার্কেট।

পক্ষান্তরে কোম্পানির ইস্যু করা আইপিও শেয়ার যেখানে বা যে পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় বা হাতবদল হয়, সেটিই হচ্ছে দ্বিতীয় স্তরের পুঁজিবাজার বা সেকেন্ডারি মার্কেট। দেশের স্টক মার্কেট হচ্ছে পুঁজিবাজারের দ্বিতীয় স্তরের বাজার। পুঁজিবাজারের জন্য দুটি পদ্ধতি অর্থাৎ প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি মার্কেট ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার বলতে স্টক মার্কেটকেই বুঝে থাকে।

বেশ কিছুদিন ধরে পুঁজিবাজারের প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি উভয় মার্কেটে মন্দা অবস্থা বিরাজ করলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা স্টক মার্কেটের মন্দা অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রাইমারি মার্কেট যেহেতু আইপিও শেয়ারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই সংখ্যায় কম আইপিও বাজারে এলে সেখানে মন্দা অবস্থা বিরাজ করে। কম আইপিও আসার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিছু লাভ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু এ কারণে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন না। আইপিও বাজার মন্দা থাকলে বিনিয়োগকারীদের চেয়ে উদ্যোক্তা বা কম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বেশি খারাপ অবস্থায় থাকে।

কেননা তারা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তাদের ব্যবসার অগ্রগতি থমকে যায়। প্রাইমারি মার্কেটের ঠিক উল্টা অবস্থা বিরাজ করে স্টক মার্কেটে। কেননা স্টক মার্কেটে মন্দা অবস্থা থাকলে উদ্যোক্তা বা কম্পানির তেমন কোনো সমস্যা হয় না বললেই চলে। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন যখন দেশের স্টক মার্কেটে মন্দা অবস্থা বিরাজ করে।

বিএসইসির সূত্র অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে সবশেষ এক বছর আগে আইপিও অনুমোদন দিয়েছিল বিএসইসি। ২০২৪ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করা চার কোম্পানির মধ্যে রয়েছে এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ও টেকনো ড্রাগস। চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে। এরপর আর কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হয়নি।

এসব বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, শেয়ারবাজারের সঙ্গে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি জড়িত। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বল্পকালীন সরকার থাকে, ততক্ষণ বিনিয়োগকারীরা নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে। এই পরিস্থিতির মধ্যে দেশে তেমন বিনিয়োগ হয় না। বিনিয়োগ যদি না হয়, মানুষ ব্যবসা সম্প্রসারণ না করে, তাহলে পুঁজিবাজার গতিশীল থাকবে না। এতে ভালো আইপিও আসবে না, ব্যবসা ভালো না চললে লভ্যাংশও ভালো আসবে না। এ রকম পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে ভালো কিছু আশা করা যায় না।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025, Jun 17