এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি-বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২১ আগস্ট সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এক সভায় বলেন, ‘… বাংলাদেশে একধরনের উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই উগ্রবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। তাহলে বাংলাদেশের যে অস্তিত্ব আছে, সেই অস্তিত্ব রক্ষা পাবে না।’
এ বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে পরিচিত তারেক রহমান লন্ডনে বসে এক অনলাইন মিটিংয়ে বলেন, ‘ধর্মীয় উগ্রবাদীদের অপতৎপরতা এবং চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে উগ্রবাদী জনগোষ্ঠী এবং পরাজিত ফ্যাসিবাদী অপশক্তি দেশে ফের গণতন্ত্রের কবর রচনা করবে।’
অথচ এই বিএনপির বিরুদ্ধে রয়েছে উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুস্পষ্ট অভিযোগ। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত শাসন আমলে সরাসরি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে বিএনপির বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার জন্য সারাদেশে জঙ্গি জিহাদিদের ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এই জঙ্গিরাই আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালায়। এক বছর পর যাতে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ বড় কোনো কর্মসূচি দিতে না পারে, সেজন্য ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের একটি বাদে সব জেলায় বোমা হামলা করা হয়।
২০০৪ সালের ১ এপ্রিল ভারতের আসাম অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য জাহাজভর্তি অস্ত্র আনতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় এই জঙ্গি গোষ্ঠী। পরে প্রমাণ মিলে এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল বিএনপি সরকার। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে প্রধানমন্ত্রীর জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নিলে তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন। সেনাবাহিনীর হাতে ভয়ানকভাবে প্রহৃত হন। তার চলৎশক্তি লোপ পায়। জীবনেও আর রাজনীতিতে জড়াবেন না- এ মর্মে মুচলেকা দিয়ে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান লন্ডনে চলে যান। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এমন একটি দল, এমন একটি মানুষও যখন একটা দেশের উগ্রবাদের উত্থান নিয়ে বিচলিত হয়, তখন বুঝতে হবে দেশটার অবস্থা কতটা নাজুক।
এত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাওয়ার দরকার নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশের তরুণদের ইসলামিক শাসন (শরিয়াহ শাসন) নিয়ে যে ফ্যান্টাসির ছড়াছড়ি দেখা যায়, তাতে ভবিতব্য সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে প্রথম ইসলামপন্থী ছাত্ররা (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকারকারী হিসেবে পরিচিত) একাধিক প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এর আগে বাংলাদেশের প্রধান দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাকা ও জাহাঙ্গীনগর) সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইসলামপন্থীদের বিপুল জনপ্রিয়তাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এসব তরুণের জীবনাচরণে ধর্মের ছিটেফোঁটা নেই। তারা হিরোইজমের ভিত্তি হিসেবে ধর্মীয় উগ্রপন্থাকে ব্যবহার করছে। একসময় তরুণরা উগ্র বামপন্থাকে যেভাবে ব্যবহার করত। এদের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের অবদান কম নয়। তারা ভর্তি নীতিমালার পরিবর্তন করে মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা।
এ উগ্রপন্থা বিস্তারে রাষ্ট্র ও মিডিয়া সমান্তরালে কাজ করছে এতদিন। এতে বর্তমান ও বিগত সরকারগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। বিএনপির মতো আওয়ামী লীগ সরাসরি মদদ না দিলেও নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছে নিরবে। সরকারি টাকায় একটা নতুন মন্দির স্থাপন না করলেও, সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রির সমমর্যাদা দিয়েছে এ সরকার।
পরিসরের দিকে লক্ষ্য রেখে সরকারগুলোর ভূমিকা আপাতত মুলতবি রাখছি। মিডিয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা যাক। বাংলাদেশের মিডিয়া তথাকথিত ইসলামিক সেন্টিমেন্টকে সামনে রাখে নিউজ করে। কখনোই পেশাদারী সংবাদ প্রকাশ করে না। গাজার মুসলমান মরলে সংবাদ করে, কিন্তু ইয়েমেনের মুসলমান মরলে চেপে যায়। চীনের উইঘুর বা পাকিস্তানের বেলোচ মুসলমানদের সংবাদ পরিবেশনের সময় মুসলিম পরিচয়টা ফিকে হয়ে আসে। গাজার চেয়ে দেড়গুণ বেশি মুসলমান থাকে পশ্চিম তীরে। তাদের নিয়ে টু শব্দ করে না বাংলাদেশের মিডিয়া। বাংলাদেশে প্যালেস্টাইনের যে দূতাবাস আছে, তা মূলত পশ্চিম তীরের, গাজার না- সেটাই অনেকে জানে না।
বোকো হারাম নাইজেরিয়ার শত শত খ্রিস্টান মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে গেলে সেটা নিয়ে কোনো নিউজ করে না বাংলাদেশের মিডিয়া। মিশেল ওবামা পর্যন্ত রাস্তায় নামলেও বাংলাদেশের মিডিয়ার চোখে তা আসে না। ইসরায়েলের গানের অনুষ্ঠান থেকে বিনা উস্কানিতে নিরীহ নাগরিককে অপহরণ করলে সেটা চেপে যাওয়ার সব চেষ্টা চলে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল ধরে আল শাবাব কী বর্বরতা চালাচ্ছে তা নিয়ে কোনো নিউজ পাবেন না বাংলাদেশের পত্রিকায়। জেএনআইএম, এডিএফ, আইএসজিএস- এসবের নাম শুনেনি বাংলাদেশের ধর্মান্ধ লোকজন। অথচ গত বছর (২০২৪) আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামিক টেররিস্টদের হাতে ১৮ হাজার ৯০০ মানুষ খুন হয়েছে।
ভারতে কেউ দোকানে গরুর মাংস বেচতে না পারলে বাংলাদেশে সেকেন্ড লিড নিউজ হয়। বাংলাদেশের অন্তত ৯০ শতাংশ মুসলমানের ধারণা, ভারতে মুসলমানরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের উঠতে-বসতে ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য আক্রমণ করা হয়। চাকরি, ব্যবসা, রাজনীতি- সর্বত্রই তারা নিগৃহিত। এদের অনেকেই জানে না ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদে তিন তিনজন মুসলমান আসীন হয়েছিলেন। ভারত রাষ্ট্রের শিক্ষার রূপরেখা যাঁর হাতে রচিত হয়েছিল, তিনি মাদ্রাসা থেকে পড়ে আসা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। যে আদিবাসীকে আমরা ‘উপজাতি’ হিসেবে অবজ্ঞা করি, সেই আদিবাসী সাঁওতাল-কন্যা এখন ভারতের রাষ্ট্রপতি। ভারতের গণতন্ত্রের ঐতিহ্য সারা দুনিয়ায় তুলনারহিত। অথচ বাংলাদেশের মিডিয়া মুসলমান পরিচয়ের জন্য গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনাকে ভারতের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করে।
বিপরীতে, আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এমিরেট অফ আফগানিস্তানকে। সেখানে অশিক্ষিত মোল্লারা কী দারুণ দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছে, তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। আফগান রুপির বিপরীতে শনৈঃ শনৈঃ কীভাবে ডলারের দাম কমছে তা জানানো হয়। কেউ বলে না মূদ্রাসংকোচনের শিকার আফগানিস্তান। এটা তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সূচক। কোকোকোলাকে হটিয়ে কীভাবে মোল্লাদের সেরাপ ‘পামিরকোলা’ বাজার নিল। কোথায় কোন বাঁধ বানাল। কিন্তু এটা কোথাও পাবেন না দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে দলে দলে আফগানরা কিডনি বেঁচে দিচ্ছে। মেয়েরা পশুর চেয়েও মানবেতর জীবনযাপন করছে। আফগানিস্তানের উন্নতির সংবাদে আকৃষ্ট হয়ে ইদানিং দলে দলে ইউটিউবার আফগানিস্তানে যাচ্ছে। সস্তা আনার-বেদানার গল্প দিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে ইউটিউব।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ইরান হাইপ ওঠে। মিডিয়াগুলো ইরানের সামরিক শক্তির বর্ণনা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। মাঝে মাঝে খুবই অবহেলার সঙ্গে পরিবেশন করা হতো শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যার খবর।
অন্ধকার রহস্যময়। রহস্যের নেশায় মানুষ অন্ধকারে যায়। তারপর আর ফেরার সুযোগ পায় না। অন্ধকার সব গ্রাস করে নেয়। আজ যারা বাংলাদেশে ইসলামি (শরিয়াহ) শাসন চায়, তারা আসলে আফগানিস্তান ও ইরানের প্রকৃত তথ্য জানে না। তাই অন্ধকারকে এত মধুময় মনে হয়।
বাংলাদেশের জিডিপি (নমিনাল) ৪৬৭ বিলিয়ন ডলার। আর এত বড়ো শক্তিশালী দেশ ইরানের জিডিপি ৪০১ বিলিয়ন ডলার। আর আফগানিস্তানের? মাত্র ১৪ বিলিয়ন!
বিশাল তেল-গ্যাসের সম্পদ নিয়ে ইরান বাংলাদেশের ধারেকাছে নাই। কেন? মোল্লাতন্ত্র। ইরানের বেকারত্ব ৯% এর উপরে। বাংলাদেশে তা ৪-এর কাছাকাছি। আর আফগানিস্তান তো ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
আশা করি পাকিস্তানের তথ্য দিয়ে লজ্জা দেয়ার প্রয়োজন নেই। আরও যেসব দেশে শরিয়াহ আইন আছে তাদের তথ্য দিচ্ছি। দয়া করে চ্যাটজিপিটিকে প্রশ্ন করে জেনে নেবেন তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। দেশগুলো হলো: সৌদি আরব, সুদান, ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ, মুসলিম অধ্যুষিত নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চল।
অন্ধকারের সামান্য কিছু তথ্য দিলাম, আরও তথ্য সংগ্রহ করুন- সিদ্ধান্ত আপনার। কোন দিকে যাবে বাংলাদেশ।