ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিকে অবিশ্বস্ত আখ্যা দিয়ে দিয়েছে ইরান। দেশটি জানিয়েছে, সম্ভাব্য নতুন সংঘাতের জন্য তারা একাধিক সামরিক পরিকল্পনা প্রস্তুত রেখেছে।
দেশটির রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা আইআরআইএনএ এক প্রতিবেদনে বলেছে, সোমবার (১৫ জুলাই) তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াসার গুলারের সঙ্গে ফোনালাপে ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদেহ এ মন্তব্য করেন।
নাসিরজাদেহ বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র এই যুদ্ধবিরতিতে আস্থা রাখে না। সে কারণেই আমরা যেকোনো নতুন আগ্রাসনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে একাধিক সামরিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আমরা অঞ্চলে যুদ্ধ ও অস্থিরতা বাড়াতে চাই না। তবে যেকোনো আগ্রাসনের কঠোর ও অনুশোচনামূলক জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
ইরানি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আলোচনার সময়েই আমাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। আমরা বিশ্বকে প্রমাণ করেছি, আমরা সংলাপ ও আলোচনার বিরোধী নই।
ইসরায়েলের হামলা, ১২ দিনের যুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের যোগদান
চলতি বছরের ১৩ জুন ইরানের ওপর বড় পরিসরের আকস্মিক বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এই অভিযানে একাধিক পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এরপর টানা ১২ দিন স্থায়ী হয় উভয় পক্ষের সংঘাত।
এই হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান বাঘেরি সহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানি সহ শত শত বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। পাল্টা হামলায় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হানে, যাতে ২৭ জন ইসরায়েলি নিহত হন।
১৫ জুন ওমানের মাসকাটে অনুষ্ঠেয় ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনা এই ঘটনার জেরে বাতিল হয়ে যায়। পরে ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ইরানের ওপর আক্রমণে অংশ নেয়। ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার’ নামে চালানো এই অভিযানে বি-টু বোমারু বিমান এবং টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে নাতানজ, ফরদো ও ইসফাহানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানো হয়।
২৪ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ডের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। যদিও এই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় রয়েছে।
গত মাসে ইরানের সংস্কারপন্থী দৈনিক শারঘ এই যুদ্ধবিরতিকে ‘আইনগতভাবে দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য’ বলে আখ্যা দেয়।
সংবাদপত্রটি লিখেছে, “এই যুদ্ধবিরতি কোনো আন্তর্জাতিক আইন, সংবিধান, নীতিমালা বা বিশ্ব সংস্থার স্বীকৃত কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বরং এটি একটি অনির্দিষ্ট ও অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি, যার স্থায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।”
অন্যদিকে, গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে পেছনে ঠেলে দিতে পেরেছে।” তবে তিনি ইঙ্গিত দেন, “ইসরায়েলের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে সংঘাত এখানেই শেষ নয়।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : পটভূমি
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান উত্তেজনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো—পারমাণবিক কর্মসূচি, আঞ্চলিক আধিপত্য, এবং সিরিয়া ও লেবাননের মতো অঞ্চলে একে অপরের প্রভাব প্রতিহত করা।
ইরান বরাবরই লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে আসছে, যাকে ইসরায়েল তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।
ইসরায়েল বিশ্বাস করে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের চেষ্টায় রয়েছে, যদিও তেহরান দাবি করে—তাদের কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ।
সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধ ছিল এ দ্বন্দ্বের সর্বশেষ ও অন্যতম ভয়াবহ পর্ব, যেখানে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিকভাবে জড়ায়। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, উভয় পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস, কূটনৈতিক অচলাবস্থা এবং পাল্টাপাল্টি হুমকির ফলে যে কোনো সময় ফের সংঘাত শুরু হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।