নিখোঁজ সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের মরদেহ উদ্ধার

সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার নিখোঁজের পরদিন তার মরদেহ মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া এলাকায় মেঘনা নদী থেকে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়।

রমনা বিভাগের উপ-কমিশনারের (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, মেঘনা নদীতে একটি মরদেহ ভেসে উঠেছে। মরদেহটি বিভুরঞ্জন সরকারের মতোই। মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে তার মরদেহ। তবে তার পরিবার সদস্যদের খবর দেওয়া হয়েছে। তারা শনাক্তের পর আমরা আরও নিশ্চিত হতে পারব।

মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার মরদেহটি মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতালে রাখা আছে। মরদেহটি শনাক্ত করতে পরিবার সদস্য রওয়ানা দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। তার সন্ধান চেয়ে রমনা থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল।

জিডিতে পরিবার জানায়, বৃহস্পতিবার সকালে কর্মস্থল আজকের পত্রিকা’র অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি রেখে গিয়েছিলেন তিনি।

উপুড় হয়ে ভাসছিল মরদেহ, আঘাতের চিহ্ন নেই

মৃতদেহের ছবি দেখে মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকরা নিশ্চিত করেছেন, উদ্ধার হওয়া মরদেহটি সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের। বর্তমানে পুলিশ তার পরিবারের স্বজনদের অপেক্ষায় রয়েছে। পরিবার নিশ্চিত করলেই পুলিশ পরিচয় নিশ্চিত করবে বলে জানিয়েছেন কলাগাছিয়া নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সালেহ আহমেদ পাঠান।

তিনি জানান, শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে খবর পেয়ে ৩টার দিকে গজারিয়ার চরবলাকী এলাকার মেঘনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় লাশ উদ্ধার করা হয়।

নৌ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সালেহ আহমেদ পাঠান বলেন, এরপর সাংবাদিকদের দেখানো ছবির সঙ্গে মরদেহের চেহারায় মিল পাওয়া যায়। এরপর বিষয়টি ঢাকার রমনা থানা পুলিশকে জানানো হয়। রমনা থানা পুলিশ তার পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। পরিবার সদস্যরা আসার পর আমরা শতভাগ নিশ্চিত হতে পারব।

তিনি জানান, মরদেহ উদ্ধারের সময় সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিকালে তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তিনি উপুড় হয়ে নদীতে ভাসছিলেন।

১৯৫৪ সালে জন্ম নেওয়া বিভুরঞ্জন সরকার ষাটের দশকের শেষদিকে স্কুল ছাত্র থাকাকালেই দৈনিক আজাদ-এ মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি দৈনিক মাতৃভূমি, সাপ্তাহিক চলতিপত্র এবং সাপ্তাহিক মৃদুভাষণ-এ গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।

আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে তার রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী লেখা ব্যাপক সাড়া ফেলে।

নিখোঁজ হওয়ার আগে ‘খোলা চিঠি’

বাসা থেকে বের হওয়ার আগে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজের ইমেইলে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছিলেন সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। তার ‘খোলা চিঠি’-তে দীর্ঘ পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতা, বঞ্চনা এবং শেষ বয়সের হতাশা তুলে ধরেছেন।

তিনি লিখেছেন, জীবনের শেষ লেখা হিসেবেই এটি প্রকাশ হতে পারে।

চিঠিতে তিনি জানান, সত্য বলার নৈতিকতা বজায় রাখতে গিয়ে কখনো কোনো সুবিধা বা পুরস্কার পাননি। প্লট, বাড়ি বা ভালো চাকরি কেউ তাকে দেয়নি। অথচ তার চোখের সামনে অনেকেই স্বার্থে আপস করে নানা সুবিধা নিয়েছেন।

শারীরিক অসুস্থতা ও আর্থিক সংকট তার জীবনকে চরম দুর্বিষহ করে তুলেছে। লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা অসুখে প্রতি মাসে বিপুল খরচ হয়, যা সামলাতে হয় অতি সীমিত আয়ের মধ্যে। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়েও তিনি দুঃশ্চিন্তায় আছেন। মেয়ের বিসিএসের থিসিসে ব্যর্থতা, ছেলের কর্মসংস্থান না পাওয়া—সব মিলিয়ে হতাশার ছবি আঁকেন তিনি।

চিঠিতে বিভুরঞ্জন সরকার সাংবাদিকতার বর্তমান সংকট নিয়েও দুঃখ প্রকাশ করেন। তার মতে, একসময় পাঠকরা তার লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকতেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে তার লেখা নিয়ে আলোচনাও হতো। কিন্তু এখন সেই আগ্রহ নেই, অনেক লেখা প্রকাশও করা হয় না। গণমাধ্যমে সত্য প্রকাশের পরিবেশ সংকুচিত হয়ে পড়েছে, সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা কমে গেছে।

তিনি আক্ষেপ করে উল্লেখ করেন, জীবনের দীর্ঘ সময় সত্য প্রকাশে দায়বদ্ধ থেকেও শেষ বয়সে তিনি উপেক্ষিত ও অবহেলিত।

সবশেষে তিনি লেখেন, নিজের সীমাবদ্ধতা থাকলেও কখনো অন্যের ক্ষতি চাননি। তবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হলো পেশাগত অবহেলা আর বঞ্চনা।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025