মায়া লাগছে নেপালের জন্যে

গত কুরবানির ঈদে নেপালে ছিলাম। এর আগেরবার নেপালে গিয়েছিলাম সেটা মোটামুটি বছর দুয়েক তো হয়ে গেছে আরকি। সেবার ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে থামেল যাচ্ছি, গাড়ীর রেডিওতে র‍্যাপ বাজছে। শুনতে বেশ লাগছিল, জিজ্ঞাসা করতে চালক জানালেন যে এই র‍্যাপ শিল্পীর নাম বলেন শাহ্‌, তিনি কাঠমান্ডুর নয়া মেয়র। বাহ, রাজধানীর মেয়র একজন র‍্যাপার, চমৎকার নয়! জিজ্ঞাসা করলাম, কোন পার্টির লোক? না, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নন, নেপালি কংগ্রেসের নন, এমনকি অন্য যেসব পার্টি আছে নেপালে সেগুলির কোনটার সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই, তিনি স্বতন্ত্র।

এটা বেশ চমকপ্রদ খবর। স্বতন্ত্র নির্বাচন করে কাঠমান্ডুর মেয়র হয়ে গেছে, কে এই যুবক? খোঁজ খবর নিয়ে যেটা জানলাম, বলেন্দ্র শাহ্‌, বলেন শাহ্ নামেই লোকে চেনে তাঁকে, তিনি একজন সিভিল এঞ্জিনিয়ার। স্নাতক ডিগ্রী নিয়ছেন নেপালেই, স্নাতকোত্তর পড়েছেন দক্ষিণভারতের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটা এঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম চালাতেন, আর র‍্যাপ করতেন। কাঠমান্ডু সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টি ইউএমএল, নেপালি কংগ্রেস এবং অন্য সব দলের প্রার্থীদের হারিয়ে জিতেছেন। কিভাবে জিতলেন? প্রথাগত রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আর যৌবনের তারুণ্যের শ্লোগান লোকে পছন্দ করেছে, ভোট দিয়েছে।

বলেন শাহ্‌র গল্পটা বেশ লেগেছিল সেবার। সেই সাথে মনের মধ্যে একটু কৌতূহলও ছিল। না, একজন জনপ্রিয় শিল্পী নির্বাচন করে মেয়র হয়েছেন সেটা তো হতেই পারেন। কিন্তু নেপালের রাজনীতির যে কাঠামো, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি ইউএমএল, কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদী, নেপালি কংগ্রেস এরা তো আছেই, ওদের ছাড়াও ২০০৮এর পর বেশ কিছু আঞ্চলিক ও জাতীয় পার্টি আছে যাদের জনসমর্থন কমিউনিস্ট বা কংগ্রেসের চেয়ে খুব বেশী পিছিয়ে নেই। ওদের সবাইকে টপকে কাঠমান্ডুর মেয়র হয়ে আসা এককভাবে একজন র‍্যাপারের জন্যে খুবই কঠিন। তাইলে কে আছে এর পেছনে? ডিজাইনটা কে করে দিয়েছে? ‌

কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহ্‌ বা বলেন শাহ্ (সংগৃহীত)

এই মধ্য রাতে বলেন শাহ্‌র কথা কেন বলছি? কাঠমান্ডু এবং পোখারায় গতকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে- ব্লকেড, মার্চ টু পার্লামেন্ট ইত্যাদি। আজ কাঠমান্ডু জ্বলছে, পার্লামেন্ট ভবন তছনছ হয়েছে, পোখারা জ্বলছে, আরও কয়েকটা শহরও জ্বলছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, মৃতের সংখ্যা সম্ভবত বেড়েছে। পুলিশ গুলি ছুড়েছে, পুলিশের উপরও আক্রমণ হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সরকার পতনের দাবী উঠেছে। এইসব দেখে কাঠমান্ডু পোস্ট এবং অন্য কয়েকটা কাগজের অনলাইন সংস্করণ দেখলাম।

আমাদের বলেন শাহ্‌ আন্দোলনকারীদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন আরও বেশ কিছু সঙ্গীত শিল্পী অভিনেতা ও সোশ্যাল মিডিয়া তারকা। এছাড়া কিছু ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার অধ্যাপক এনারাও আছেন। ভাল করে ঘটনাবলী দেখতে গিয়ে দেখি এই বিক্ষোভ দৃশ্যত স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলেও ঠিক পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত নয়, খানিকটা পরিকল্পনার ছাপ আছে, খুব স্পষ্ট আমার পক্ষে ঢাকায় বসে বুঝা সম্ভন না, কিন্তু মনে হয় কেউ যেন আন্দোলনটা ডিজাইন করেছে। ডিজাইনটা কতোটুকু মেটিকিউলাস সেটা ঠিক এখনই বলা সম্ভব নয়, তবে ডিজাইন একটা আছে, এবং ডিজাইনটা কেমন যেন চেনা চেনা। রঙিন।

বলেন শাহ্‌র বক্তৃতা বিবৃতি ছেপেছে কাগজগুলি। বলেন শাহ্‌ বলছেন আমি ওদের সাথে আছি, বিক্ষোভে আমি নিজেই যেতাম কিন্তু বিক্ষোভে নামার একটা বয়সও সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, ২৮ বছরের বেশী কেউ যাবে না, এই জন্যে আমি যাচ্ছি না। ও, তাইলে আগে থেকে অংশগ্রহণকারীদের একটা বয়স সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে! বেশ। এইজন্যেই কি তবে সব কয়টা ব্যানারে ফেস্টুনে এটাকে জেন-জি প্রটেস্ট লেখা হচ্ছে? সেইভাবেই ডিজাইন করা? এবং সংবাদ মাধ্যমগুলিকে ব্রিফ করা হচ্ছে একইভাবে, জেন-জি প্রোটেস্ট, ওড়া খবরের শিরোনামও করছে সেইভাবেই।

আন্দোলনটা শুরু হয়েছে কিভাবে? নেপাল সরকার ফেসবুক টুইটার ইন্সটাগ্রাম হোয়াটসএপ এইগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে- ওদেরকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, তোমরা নেপালে নিবন্ধন কর, নেপালে ট্যাক্স দাও, নাইলে বন্ধ করে দেওয়া হবে। সরকার কেন এটা করতে গেল? নেপালের সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করো, সরকার সেই অনুযায়ী কাজ করেছে। সরকারের নিজস্ব কিছু কারণও আছে। অপপ্রচার হচ্ছিল ইত্যাদি। সোশ্যাল মিডিয়াগুলি সরকারের নির্দেশ মানেনি। সরকার দিয়েছে সব বন্ধ করে। এইটা থেকে বিক্ষোভ শুরু। জেন-জি প্রোটেস্ট। আমাদের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা খর্ব করেছে সরকার। সাথে দুর্নীতি এবং অন্য কিছু অভিযোগ।

না, অভিযোগগুলি মোটেই ভুল নয়। সোশ্যাল মিডিয়া এইরকম সম্পুর্ন বন্ধ করে দেওয়া সেটা তো অবশ্যই বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বটেই। এইরকম ন্যায্য একটা ক্ষোভ না থাকলে তো বিক্ষোভে লোক আসতো না। গত কুরবাণীর সময় যখন পোখারায় ছিলাম, তখন দেখলাম কয়েকটা দল মিলে রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবীতে একটা দুইটা হরতাল এবং বিক্ষোভ ইত্যাদি কর্মসূচী নিয়েছিল। সেইগুলি কর্মসূচী খুব একটা জমেনি। আমরা ঠাট্টা করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলাম, অনেক দেশেই ইএরকম ফার্স্ট ওয়েভ সেকেন্ড এটেম্পট ফেইল করার পরই মুল বঙটা বিকশিত হয়- বিস্ফোরিত হয়।

এখন যে সরকারটা রয়েছে নেপালে, কমিউনিস্ট পার্টির সরকার, নেতৃত্বে আছেন কে পি শর্মা অলি, এরা কিন্তু নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার। এরা জনপ্রিয়তা হারায়নি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে প্রচারণাটা চলছিল যে, না, এইসব ন্রিবাচত সরকারগুলি সব চোর, স্বার্থপর, জনগণের কথা ভাবেনা ইত্যাদি। আমরা কোন দলীয় সরকার চাই না, সব দল খারাপ ইত্যাদি। একটা চেতনা তৈরির চেষ্টা চলছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপক্ষে। এটার উপর ভিত্তি করেই রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনটা জমানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, কাজ হয়নি। কারা এইরকম প্রচারণার পৃষ্ঠপোষক সেটা আমি অনুমা করতে পারি, আপনিও হয়তো পারছেন, এগুলি তো নিশ্চিত করা যায় না আরকি।

নেপালের মানচিত্রটা তো আপনারা জানেন- একপাশে চীন, আরেকপাশে ভারত। দেশটার উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় এই দুই দেশের মধ্যে টানাটানি তো পুরনো। সম্প্রতি তো আবার ভারত চীন খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে এসেছে- ওদের মধ্য পুরনো বৈরিতা নাকি কমে এসেছে। সেই ক্ষেত্রে নেপালের খুবই সুবিধা হতো। চীনের সাথে ভারতের এই নয়া মুহব্বত কি তবে কারো চোখে বালির মতো বিঁধছে? কেউ কি চীন ও ভারতের মাঝখানের এই চমৎকার দেশটাকে নিজেদের স্বার্থে ঐ দুই দেশের বিপক্ষেই ব্যবহার করতে চাইছে? চীন ও ভারতের মাঝখানে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছে? জানিনা।

মায়া লাগছে নেপালের জন্যে। আমার নিজের দেশের পরে এই দেশটার প্রতিই আমার প্রবল ভালোবাসা আছে। নেপালে গেলেই আমার ভাল লাগে, এতো সুন্দর দেশ, এতো সুন্দর ওদের মানুষ! সুযোগ থাকলে বছরের যে কোনদিন আমি ছুটে যেতে পারি নেপালে। নেপালি ডাল ভাত আমি প্রতিবেলা খেতে পারি, ওদের যে দিশী পানীয়টা আছে, রক্সি, মিলেট থেকে বানায় (মিলেটকে বাংলায় কি বলে? বজরা?), স্বাদটা একটু ভিন্ন হলে তবে বানানোর পদ্ধতিটা মোটামুটি আমাদের দচুনির মতোই, সেটা যে কি সুস্বাদু। আহা, এতো সুন্দর দেশটা কি তবে বীভৎস রঙে তছনছ হবে!

মায়া লাগছে। আপনি কি জানেন, নেপাল হচ্ছে তথাগত বুদ্ধের নানাবাড়ি আবার শ্রী রামের শ্বশুরবাড়ি! মায়া লাগছে নেপালের জন্যে।

Tags :

Imtiaz Mahmood

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025