সালমান শাহ : আজও অজানা মৃত্যুরহস্য

আজ ৬ সেপ্টেম্বর। ২৯ বছর আগের এই দিনে ঢাকার নিউ ইস্কাটন গার্ডেনের ভাড়া বাসা থেকে বাংলাদেশি সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহ’র মরদেহ উদ্ধার হয়।

মরদেহ উদ্ধারের দিন তার স্ত্রী সামিরা হক পুলিশকে জানান, ড্রেসিংরুমের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমান শাহকে দেখে তারা দেহটি নামিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেন। পরে চিকিৎসকরা সালমান শাহকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরে এ ঘটনায় রমনা থানায় মামলা হয়। সেই মামলায় তিন ধরনের তদন্ত হয়েছে। সব তদন্তে এটাকে আত্মহত্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সর্বশেষ পিবিআইয়ের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর রিভিশন দায়ের করে বাদীপক্ষ। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর মামলাটি শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে।

সব মিলিয়ে ২৯ বছরেও অজানা সালমান শাহর মৃত্যুরহস্য। সালমান শাহ’র ৮১ বছর বয়সী মা নীলা চৌধুরী ছেলে হত্যার বিচারের অপেক্ষায় আছেন।

সালমান শাহ’র মৃত্যুতে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন তার বাবা প্রয়াত কমর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। তবে মৃত্যুর এক বছর না যেতেই ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ এনে আদালতে মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন জানান তিনি। ফলে সালমান শাহ’র মৃত্যু নতুন রহস্যে রূপ নেয়।

মামলাটি তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। ওই বছরের ২৫ নভেম্বর ওই প্রতিবেদন গৃহীত হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে। কিন্তু সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী দায়রা আদালতে রিভিশন মামলা দায়ের করেন। ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি দ্বিতীয় দফায় বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। প্রায় ১১ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এ প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর তিনি বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।

২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে নারাজি দাখিল করেন। নারাজি আবেদনে উল্লেখ করা হয়, আজিজ মোহাম্মদ ভাই, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, নজরুল শেখ, সামিরা হক, লতিফা হক লুসি, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও মনোয়ারা বেগম সালমান শাহর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। মামলাটি র‌্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।

পরে এতে বাধা দেন রাষ্ট্রপক্ষ। র‌্যাবকে তদন্ত ভার দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করেন মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ-৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েস (বর্তমানে বিচারপতি) রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশনটি মঞ্জুর করেন এবং র‌্যাব মামলাটি তদন্ত করতে পারবে না বলে আদেশ দেন। এরপর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। দীর্ঘ চার বছর আলোচিত এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই ৪৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে। ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও নেয়। সংশ্লিষ্ট আলামতও জব্দ করা হয়। তবে মামলার একজন সাক্ষীকে খুঁজে পায়নি পিবিআই। সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে বলে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিবিআই’র পরিদর্শক সিরাজুল আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে সালমান শাহর মৃত্যুতে পাঁচটি কারণ খুঁজে পায় পিবিআই। কারণগুলো হলো– চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে সালমান শাহর অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা; সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ; মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টা; মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসায় জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রূপ নেওয়া এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।

পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদের আদালত ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর পিবিআই’র দেওয়া প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আসামিদের অব্যাহতির আদেশ দেন। এরপর আবার সালমান শাহর পরিবারের পক্ষ থেকে রিভিশন দায়েরের আবেদন করা হয়। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক কেএম ইমরুল কায়েশ রিভিশন আবেদন গ্রহণ করেন। মামলাটি বর্তমানে রিভিশন শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।

ছেলে আত্মহত্যা করেছিল নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছিল তা না জেনেই ২০০২ সালে মারা যান সালমান শাহ’র বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী।

সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী বলেন, একটা মায়ের আর কি চাওয়া থাকতে পারে? ২৯ বছরেও সন্তান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। আর কত সময় গেলে সন্তান হত্যার আসল রহস্য জানতে পারবো? আমার একটাই দাবি– ছেলে হত্যার বিচার চাই। মৃত্যুর আগে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেতে চাই। কি দোষ ছিল তার, কেনই বা তাকে হত্যা করা হলো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাদীপক্ষের আইনজীবী মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন সঠিক হয়নি বলে আমরা রিভিশন দায়ের করেছি। এই রিভিশন আবেদনকারী নীলা চৌধুরী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যান্ডে রয়েছেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ। তার ভাই আলমগীর কুমকুমকে রিভিশনকারী হিসেবে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছেন। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর মামলাটি শুনানির জন্য তারিখ ধার্য রয়েছে।

সালমান শাহ’র মামা আলমগীর কুমকুম বলেন, বিচারের মালিক আল্লাহ। ২৯ বছর পার হয়ে গেলো। এতো দিনেও বিচার হয়নি, আশা করি এই সরকারের সময়ে বিচার হবে। আমাকে আদালত থেকে ডাকা হয়েছে। বিগত সরকার একতরফাভাবে বিচার করে গেছে। বর্তমান সরকারের প্রতি আমরা আশাবাদী।

তিনি বলেন, পরিবারে কেউ মারা গেলে থানা থেকে সবাইকে ডাকা হয়। গ্রেফতার হয়, রিমান্ডেও নেওয়া হয়। কিন্তু এসবের কিছুই করা হয়নি। সালমান শাহকে ঝুলন্ত অবস্থায় নামিয়ে গোসল করালো, নতুন কাপড় পরালো। সালমান শাহ অসুস্থ, তার মাকে ফোন দিয়ে পর্যন্ত জানালো না। এমনকি ঘটনার দিন বাড়িতে কোনও কাজের লোকজনও নেই। ঘটনার পর বাড়ির কাজের মানুষ ডলি, মনোয়ারা, আবুলকে পর্যন্ত থানা থেকে ডাকা হয়নি। এর ভেতর তো রহস্য আছে। আমার একটাই দাবি, প্রকৃতি অপরাধীরা যেন বের হয়ে আসে এবং তারা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি হয়।

মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সালমান শাহর বাসায় ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যান তার বাবা। কিন্তু সালমানের ব্যক্তিগত সহকারী আবুল ও তার স্ত্রী সামিরা বলেন, সালমান রাত জেগে কাজ করেছেন, এখন তাকে ঘুম থেকে ডাকা যাবে না। তিনি প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে বাসায় ফিরে আসেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সেলিম নামে একজন ফোন করে জানান, সালমান শাহর কী যেন হয়েছে। পরে সালমান শাহর বাবা, মা ও ভাই তাৎক্ষণিক তার বাসায় ছুটে গেলে শয়ন কক্ষে নিথর দেহ দেখতে পান।

বিচারের অপেক্ষায় সালমান ভক্তরা

এ বছরের ২৬ আগস্ট ঢাকা মহানগর আদালতের সামনে সালমান শাহর ভক্তরা মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে তারা বলেন, বিগত সরকার সঠিকভাবে সালামন শাহ হত্যার তদন্ত করেনি। সে জন্য এ সরকারের উচিত তার মৃত্যু রহস্য খতিয়ে দেখা।

মানববন্ধনে সালমান শাহ’র ভক্ত মনিরা আক্তার বলেন, ১৯৯৬ সালে ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহকে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে বিএনপি, আওয়ামী লীগের সরকাররা ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এ হত্যার কোনও রহস্য উদঘাটন হয়নি। বর্তমানে দেশে পরিবর্তন এসেছে। আমরা চাই, বর্তমান সরকার এ হত্যার যথাযথ তদন্ত করুক। প্রকৃত আসামিরা বেরিয়ে আসুক।

আরেক ভক্ত বলেন, পিবিআই আত্মহত্যার যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে, সেটাতে অনেক ত্রুটি আছে। হত্যার যে ফ্যান সেটি পিবিআই আলামত হিসেবে নেয়নি। ওই রুমে ইঞ্জেকশনের আলামত পাওয়া যায়। ওই সময় সালমানের রুমের ছবি আমাদের কাছে আছে। সেখানে দুটি রশি পাওয়া যায়; যেগুলো খুবই চিকন। একটা মানুষ যদি মারা যায়, ফ্যানের প্লাস্টিকের কাভার কী তার ভারে ভাঙবে না? রশিটা আলতোভাবে লাগানো ছিল, অনেকটা গ্যাপ। এতো এতো আলামত থাকার পরও কেন পিবিআই ভুল তদন্ত করলো আমরা জানি না।

অহিত নামে সালমান শাহর এক ভক্ত বলেন, গত ২৬ আগস্ট ঢাকার জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে বিচার চেয়ে আমরা মানববন্ধন করি। সারা দেশের মানুষ সালমান শাহকে অনেক ভালোবাসে। মামলায় অনেক গাফিলতি রয়েছে। ঘটনার বিষয়বস্তু দেখে বোঝা যায় এটা হত্যাকাণ্ড।

সালমান শাহ’র মৃত্যুতে বাড়ির কাজের মানুষ ও সাবেক স্ত্রীকে অভিযুক্ত বলে দাবি করেন এই ভক্ত।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন

Tags :

Entertainment Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025