.বরিশালের বাবুগঞ্জ-মুলাদী এলাকার একজন নায়কের গল্প বলি। একজন নারী নায়ক, পৃথিবীর যে কোনো দেশের ইতিহাসেই দেশের মানুষ স্মরণে রাখবে পরম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় এইরকম একজন বীর যোদ্ধা, করুণা বেগম।
পড়াশোনা কী করেছিলেন জানি না, খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায় করুণার। করুণার স্বামী একসময় সেই সময়ের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআরএ চাকরি করেছে কিছুদিন, পরে প্রাইমারি স্কুলের টিচার হয়েছে। একটি পুত্রসন্তান হয়েছে ওদের ঘরে, ছেলেটার নাম রেখছিল ওরা আবদুল মান্নান। তরুণী গৃহবধূ করুণা সুখে সংসার করছিল যখন ১৯৭১ শুরু হয়। যুদ্ধের সূচনায় করুণার স্বামী শহিদুল হাসান বাবুগঞ্জ-মুলাদী এলাকার তরুণদের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠাতেন ভারতে আর নিজ এলাকায় কিছু ছেলে-মেয়েকে প্রাথমিক ট্রেনিং দিতেন। এপ্রিলে বরিশালে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করে, রাজাকাররা ওদের সাথে যোগ দেয়। এর কিছুদিন পর পাকিস্তানি বাহিনী আর পাকিস্তান আর্মি শহিদুলসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। জয়ন্তী নদীর ধারে ওদেরকে গুলি করে হত্যা করে।
কি চমৎকার মিষ্টি নাম নদীটার! জয়ন্তী। এই জয়ন্তী নদীর ধারে আমাদের একদল উজ্জ্বল যোদ্ধাদের হত্যা করে পাকিস্তানিরা, ওদেরকে সাহায্য করেছিল রাজাকাররা। সেইসব শহীদদের দলে করুণার স্বামী শহিদুলও ছিল। করুণার তখন দিশেহারা অবস্থা, বুকে তাঁর শিশু সন্তান, স্বামী সদ্যমৃত। কী করবে? বেশিদিন কাঁদতে বসেনি করুণা। শিশু মান্নানকে মায়ের কাছে রেখে করুণা যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। কমান্ডার কুতুবউদ্দিনের অধীনে ট্রেনিং নেয় সে। শারীরিক ট্রেনিং, রাইফেল, স্টেনগান চালানো আর এক্সপ্লোসিভ ব্যবহারে দক্ষ হয়ে ওঠে। এরপর থেকে কখনও ভিখির বেশে একা একা, কখনও ছোট ছোট দলে গিয়ে চোরাগুপ্তা হামলা করা, গ্রেনেড ছুড়ে মারা এসব অভিযান চালায় করুণা।
নভেম্বরের শেষের দিকে একটি বড় অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পায় করুণা। পনেরজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল, ওদের মধ্যে পাঁচজন নারী আর দশজন পুরুষ। নেতৃত্বে আমাদের করুণা বেগম। মাহিলারা নামে একটা জায়গায় মিলিটারি আর রাজাকারদের একটা সুরক্ষিত ক্যাম্পে সরাসরি হামলা করে এই দলটি। চারদিক ব্যাংকার করা সুরক্ষিত ঘাঁটিটি ওরা ঘিরে ফেলে। আক্রমণের সূচনা করে করুণা- পরপর পাঁচটি গ্রেনেড ছুড়ে ব্যাংকার আর ব্যাংকারে অবস্থান নেওয়া সৈন্যদের উড়িয়ে দেয়। এরপর চার ঘণ্টা ধরে চলে মুখোমুখি গুলি বিনিময়। দশজন পাকিস্তানি সেনা ঘায়েল হয়, বাকিরা কেউ পালিয়ে যায়, কেউ আত্মসমর্পণ করে। অভিযানের অধিনায়ক করুণার পায়ে গুলি লাগে, গুরুত্বর আহত হন তিনি।
আপনি যদি বাবুগঞ্জ-মুলাদী এলাকায় যান কখনও, সেখানকার মুরুব্বিদের জিজ্ঞাসা করলে ওরা এখনও আপনাকে বলবে আমাদের এই বীর নারীর দুরন্ত সাহসী নেতৃত্বের কথা। আপনি ভাবুন তো, একটি আঠারো-উনিশ বছরের শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট পরা তরুণী, হাতে হয়তো পরেছিল সস্তার রঙিন চুড়ি, মাথার রুক্ষ কালো চুল শক্ত করে বাধা, এই মেয়েটা পনেরজন মুক্তিযোদ্ধার দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে একটা অসম যুদ্ধে। ওর প্রতিপক্ষ সুশিক্ষিত ভারি অস্ত্র শস্ত্র গোলা বারুদে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল। কল্পনা করুন দৃশ্যটা। ক্যাম্পটি দখল করে ওরা যখন জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করছে তখন হয়তো শীতের শীর্ণ জয়ন্তী নদীটিও উত্তাল হয়ে উঠেছিল।
করুণার আঘাত গুরুতর ছিল। যুদ্ধের সময় ভালো চিকিৎসা হয়নি, স্বাধীনতার পর ঢাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা হয় এই অসমসাহসী বীরের। ২০০৯ বা ১০ সনের দিকে মারা যান তিনি। অসম সাহসিকতার জন্য কী পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি জানেন? বঙ্গবন্ধু তাঁকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, চিঠিতে বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখে সম্বোধন লিখেছিলেন ‘প্রিয় বোন করুণা’ বলে। ব্যক্তিগত প্যাডে লেখা সেই চিঠিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, ‘তাই, বাংলাদেশ সরকার, জনগণ ও আমার নিজের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ’- এটাই এই সাহসী নারীর পাওয়া একমাত্র উল্লেখযোগ্য পুরস্কার।
পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখবেন ছোট ছোট শহরে ওরা ওদের বীরদের ভাস্কর্য বানিয়ে শহরের কেন্দ্রে রেখে দেয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বীরদের স্মৃতি থেকে অনুপ্রেরণা নেয়। আমি এরকম কোথাও গেলে, এসব নায়কদের গল্প জানতে চেষ্টা করি। কখনও কখনও ওদেরকে বলি আমাদের বীরদের গল্প। ইন্দোনেশিয়ায় একবার স্থানীয় বন্ধুদের কাছে বলেছিলাম আমাদের নারী মুক্তিযোদ্ধা কয়েকজনের গল্প। ওরা মুগ্ধ হয়ে শুনেছে, একজনের চোখের কোনায় জলও দেখেছি। আমার দিকে তাকানোর দৃষ্টি ওদের বদলে গিয়েছিল, আমাকে ওরা দেখছিল এইসব সাহসী বীরদের উত্তরপুরুষ হিসেবে। একজন বললেন, তোমার নিশ্চয়ই ওদের ভাস্কর্য বানিয়ে রেখেছ দেশের সর্বত্র। আমি কোনো জবাব দিইনি।
আমাদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু তো তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তথাপি, চলেন আমরাও একবার এই বিজয়ের মাসে তাঁকে স্মরণ করে আরেকবার সালাম জানাই।
করুণা বেগম আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু ওর স্বাধীন করা এই দেশ আছে। সেই জয়ন্তী নদী এখনও আছে। সেই বাবুগঞ্জ, সেই মুলাদী এখনও আছে। যে রাজাকাররা করুণার স্বামী শহিদুল মাস্টারকে ধরিয়ে দিয়েছিল, ওরাও গুটি গুটি পায়ে ফেরত আসতে চাইছে। আমাদের সবচেয়ে মহান যে কীর্তি, সবেচেয়ে গৌরবের যে অর্জন, সবকিছুকে নিয়ে ওরা প্রশ্ন তুলতে চাইছে। আমি ওদের ঐসব লাফালাফি দেখে হাসি। ওরে রাজাকারের বাচ্চারা, এই দেশ করুণা বেগমের দেশ। বুঝে-শুনে লাফ দিবি।




