আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনীতিতে আস্থার ঘাটতি, রাজস্ব আহরণে ধীরগতি, লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও জ্বালানি সংকট আর পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট। ফলে বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত জনগণের আস্থা ফেরানো, ব্যাংক খাত সংস্কার, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রফতানি আয়ে গতি ফেরানো, রাজস্ব ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনা এবং সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নিশ্চিত করার দিকে।
মঙ্গলবার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সিপিডির তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনায় এসব কথা বলা হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির মতে, বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ দেখতে চায়। চলমান প্রবণতায় চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে বলেও ধারণা সিপিডির।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। তা না হলে কর্মসংস্থান হবে না; প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। দারিদ্র্য বেড়ে যাবে। এতে বৈষম্যও বাড়বে। তাই এখন নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দেওয়ার প্রয়োজন। সেটা ডিসেম্বর, জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি হোক। বিষয়টি হলো, সুনির্দিষ্ট সময় দেওয়া দরকার।
সিপিডির তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনায়, দেশের অর্থনীতির বিশ্লেষণে একটি বড় বাধা হলো সময়মতো নির্ভরযোগ্য তথ্যের অপ্রাপ্যতা। মে ২০২৫ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায় মাত্র ৫.৩ শতাংশ বেড়েছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাকি সময়ে প্রয়োজন ৬৪.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি-যা বাস্তবসম্মত নয়। বাজেট বাস্তবায়নও সন্তোষজনক নয়; এডিপি অগ্রগতি কমেছে, আর ব্যয় মূলত ভর্তুকি, স্থানান্তর ও সুদ খাতে কেন্দ্রীভূত।
অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধ সক্ষমতায় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে সিপিডি বলছে, ঘাটতি মোকাবিলায় নতুন রাজস্ব উৎস খোঁজা, রাজস্ব সংগ্রহে দক্ষতা বাড়ানো এবং দুর্নীতি রোধের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে ধার গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি, যাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বিঘ্নিত না হয়। সীমিত রাজস্ব সক্ষমতার মধ্যে ‘টাকার যথাযথ মূল্য’ নিশ্চিত করতে হবে, অর্থাৎ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
মূল্যস্ফীতির বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, টানা দুই বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে মূল্যস্ফীতি। রূপান্তরযোগ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়েছে। বাজেটে যদি ভর্তুকি হ্রাস, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি কিংবা ভ্যাট বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে মূল্যস্ফীতি আরো উর্ধ্বমুখী হতে পারে। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থার সংস্কার, বাজার মনিটরিং জোরদার এবং কার্টেল নিয়ন্ত্রণ জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের বাফার স্টক বাড়ানো এবং মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।
সিপিডির মতে, প্রতিবছর বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ ও পরিচালন ব্যয়ে ক্রমাগত বৃদ্ধি ব্যাংক খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১.৬৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের আস্থা কমে যাওয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল নজরদারির কারণে ব্যাংক খাতে পুনর্গঠন জরুরি।
বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯.৯ বিলিয়ন ডলারে, যা আমদানি ব্যয়ের তুলনায় ৩ মাসেরও কম সময়ের জন্য যথেষ্ট। এ অবস্থায় বিদেশি সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। আগামী বাজেটে সরকার ৯.৭৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ৯ মাস পার হলেও নতুন কোনো আইপিও আসেনি, বরং আগের দুর্নীতি ও প্রশাসনিক জটিলতা বাজারকে স্থবির করে রেখেছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কার্যক্রমে বিলম্ব এবং আমলাতান্ত্রিক ধীরগতি সংস্কার প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল গঠন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সুপারিশ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বাজারে আস্থা ফেরাতে নিয়মতান্ত্রিক সংস্কার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে নানামুখী সংকট এখন শিল্প, ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। ২০২০ সালে যেখানে গ্যাস উৎপাদন ছিল ২৪,৯৯৩ এমএমসিএফ, তা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ২১,০৭৫ এমএমসিএফ। আমদানিনির্ভর এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, ফলে খরচ ও ভর্তুকির চাপ বাড়ছে। জ্বালানির উচ্চমূল্য শিল্প খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, অনেক কারখানা আংশিকভাবে বন্ধ বা অকার্যকর অবস্থায় আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়লেও গ্যাস সংকট, দুর্বল অবকাঠামো ও সমন্বয়ের অভাবে লোডশেডিং বেড়েছে। জ্বালানি দামে অস্বচ্ছতা, দুর্বল সমন্বয় এবং সুশাসনের ঘাটতি জনআস্থা ক্ষুণ্ন করছে। গ্যাস অনুসন্ধান, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণ এবং প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজে পেতে হবে।
সরকার বিনিয়োগ বাড়াতে সম্মেলন করে ব্যবসায়ীদের সমস্যার কথা জানলেও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে বলে জানান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগের এই অনিশ্চয়তা কাটবে না।
তিনি বলেন, নির্বাচন যে অনিশ্চিত তা নয়। সরকার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছে। হয় এখন থেকে ৯ মাস পরে হবে, না হয় ১৫ মাসের মধ্যে হবে। তবে নির্বাচন হয়ে গেলেই যে বাংলাদেশ দ্রুত একটা প্রবৃদ্ধির জগতে প্রবেশ করবে, তা কিন্তু কেউ বলছে না।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত যে বিনিয়োগ হবে না, তা নয়। গ্যাস সংকটের কারণে এখন বিনিয়োগ হচ্ছে না। আমাদের ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো কার্যকর করা দরকার, বাপেক্সকে শক্তিশালী করে গ্যাস সংকট দূর করা দরকার। লজিস্টিক পলিসি বাস্তবায়ন দরকার। এগুলো করতে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষার দরকার নেই। এগুলো এখন না করলে নির্বাচনের পরও বিনিয়োগকারীদের এসব সংকট দূর করা যাবে না।
কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে তিনি বলেন, যদিও বাজেটে এর বিধান থাকতে পারে, এই ধরনের পদক্ষেপ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এবং রাজনৈতিকভাবে সমস্যাযুক্ত।