তারামন বিবি: রণাঙ্গনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযুদ্ধে যে দুইজন নারী মুক্তিযোদ্ধা বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন তার মধ্যে তারামন বিবি অন্যতম। দুর্ধর্ষ এই মুক্তিযোদ্ধা একদিকে যেমন রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি গুপ্তচর হয়ে হানাদারদের ক্যাম্পের গোপন খবর পৌঁছেছেন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে।

তারামন বিবির আসল নাম ছিল তারাবানু। জন্মেছিলেন কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুরের শংকর মাধবপুর গ্রামে ১৯৫৭ সালের কোনো এক দিনে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। তারাবানু হঠাৎ দেখলেন দলে দলে ট্রাকে ট্রাকে সৈন্য নামছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে দেশে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের গ্রামটি পড়েছিল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে। তখন ১১ নম্বর সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের।
একদিন মুহিব হাবিলদার নামে স্থানীয় এক মুক্তিযোদ্ধা তারাবানুদের বাড়িতে এসে বললেন তাদের কাজের বেশ ঝামেলা, সব পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা। তারাবানু যদি ক্যাম্পে রান্না-বান্না, ধোয়া-মোছা করে দেন তবে বিনিময়ে তাকে কিছু টাকা দেবেন ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা। শুনে রাজি হলেন না তারাবানুর মা। মুহিব হাবিলদার দেখলেন বহু বোঝানোর পরেও কিছুতেই টলছেন না তারাবানুর মা। তাই মুহিব হাবিলদার তারাবানুর মাকে বললেন, ‘ও আমার ধর্ম মেয়ে, আমি তো ওর বাবার মতোই। সব দায়িত্ব আমার। আপনার মেয়ে ভালো থাকবে।’ অবশেষে গ্রামের পাশে দশঘরিয়ায় মুক্তিবাহিনীর সেই ক্যাম্পে রান্নার দায়িত্ব নিতে মেয়েকে ছাড়তে রাজি হলেন তারাবানুর মা। মুহিব হাবিলদারই তার নামের শেষে যুক্ত করেন তারামন।

মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে তারামন রান্নার পাশাপাশি, ধোয়া-মোছা ও মাঝে মাঝে অস্ত্র সাফ করতেন। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। একবার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে তাকে অস্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে মুহিব হাবিলদার খানিকটা অবাক হলেন। তারামনের যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে অস্ত্র চালানো শেখান তিনি। বয়সে ছোট হওয়ায় তারামনকে স্টেনগান চালানো শেখালেন।

একবার সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা। মধ্যদুপুরে সবাই খেতে বসেছে তখন, কেবল তারাবানু খেয়ে-দেয়ে চারপাশে নজর রাখছেন। সুপারি গাছের উপরে উঠে দৃষ্টি রাখছেন। হঠাৎ দেখলেন পাকিস্তানিদের একটি গানবোট দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে জানালেন কমান্ডারকে। সবার খাওয়া চলছে তখন। খাওয়া ছেড়ে সবাই নিজ নিজ অবস্থান নিয়ে নিলেন মুহূর্তের মধ্যেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত সম্মুখযুদ্ধ চলে। তারাবানু না দেখলে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন মাটির সঙ্গে মিশে যেতেন।

সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও তারাবানু গুপ্তচর সেজে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ঢুকে তথ্য নিয়ে আসতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তারাবানু দারুণ অভিনয় করতে পারতেন চোখের পলকেই। কখনো পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ঢুকেছেন মাথায় চুলে জট লাগানো পাগলের বেশে, কখনো সারা শরীরে কাদা লাগিয়ে, আবার কখনো পঙ্গুর অভিনয় করে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ঢুকতেন। শুনতেন নানা গোপন তথ্য। ক্যাম্পের সবাই মনে করতো পাগল নয়তো মাথায় ছিটগ্রস্ত। বিভিন্ন অপারেশনের আগে কলার ভেলায় করে তারামন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের রসদ, অস্ত্র, গোলাবারুদ পৌঁছে দিয়েছেন জায়গামতো।

তেমনই এক ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের অক্টোবর মাসের। একপাশে খালিয়াভাঙ্গা, অন্যপাশে ভেড়ামারি খাল। এক পাশের গ্রামে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প, অন্য গ্রামে পাকিস্তানিদের। মধ্যে একটা খাল পড়েছে। সারা শরীরে কাদা মেখে আর পাগলের বেশ ধরে সেবার পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে গিয়েছিলেন তারামন। সামনে তখন হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। তারামনের সারা গায়ে কাদা, মাথায় চুলের জট, কাপড় ছেঁড়া, হাত-পা যেন অনেকখানি বিকলাঙ্গ। তারামনকে দেখে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা অশ্লীলভাবে গালি দিচ্ছিল, জবাবে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছিলেন তারামন। এদিকে আর্মির সদস্যরা ভাবলো পাগলের কত রকমফের। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টায় লিপ্ত হলো তারা। এই ফাঁকে তারামন পাগলের বেশে মোটামুটি রেকি করে নিলেন ক্যাম্পের সমস্ত জায়গা। কোন পাশে হামলা করলে সবচেয়ে ভয়ংকর হবে পাকিস্তানিদের জন্য, কোন পয়েন্ট দিয়ে হামলা করতে হবে- এসব মাথায় নিয়ে ফিরে গেলেন। পাকিস্তানিদের ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সাঁতরে খাল পেরিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে এলেন। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডারকে সব বললেন খোলাখুলিভাবে। তার নির্ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নদীর অপর পাড়ে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে আক্রমণ হলো পরদিনই।

কেবল এই দুটো অপারেশনই নয়। মোহনগঞ্জ, তারাবর কোদালকাটি, গাইবান্ধার ফুলছড়ির বহু বিখ্যাত যুদ্ধে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তারামন বিবি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু এ খবরও জানতে পারেননি তারামন। একসময় পুরোপুরি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে তার খোঁজ মিলে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপক গবেষক বিমল কান্তি দে’র মাধ্যমে। তাকে সহযোগিতা করেছিলেন তারামন বিবির জন্মস্থান কুড়িগ্রামের রাজীবপুরের কলেজের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকী। মূলত মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর কাজ করতে গিয়ে দেখলেন তারামন বিবিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে অধ্যাপক আবদুর সবুর ফারুকী ও সোলায়মান আলীর মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে।
এমনকি বিয়ের পর তারামন বিবির স্বামী আব্দুল মজিদও জানতেন না যে তার স্ত্রী একজন মুক্তিযোদ্ধা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যায় যে মুক্তিযোদ্ধা, হেইটা বিয়ের পরও বুঝি নাই। লেহাপড়া নাই। চর্যার মধ্যে বাড়ি। পেটের ভাত জোগাড় করতেই দিন চইলা যাইত, হ্যাই খবর কেমনে নিমু?’ তারা তাকে জানতেন তারাবানু। তাদের বাড়িতে তারামন বিবির খোঁজে গিয়ে খোঁজ নেয়া অধ্যাপকেরাই কাগজপত্র দেখিয়ে বলেছিলেন– এই তারাবানুই হচ্ছে তারামন।

তাকে খুঁজে পাওয়ার খবরটি ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর দৈনিক ভোরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তারামন বিবির হাতে তুলে দেন বীর প্রতীক সম্মাননা।

২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর সবাইকে ছেড়ে যান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীক। বিজয়ের মাসে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এই কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধাকে।

তথ্যসূত্র: নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীক– তাজুল মোহাম্মদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও নারী মুক্তিযোদ্ধা (প্রথম খণ্ড)– মেহেরুননেসা মেরী, রণাঙ্গনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীক– দ্যা ডেইলি স্টার, ১ ডিসেম্বর ২০২১

Tags :

মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025