১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সপ্তম নৌবহরের আটটি জাহাজ অবশেষে বঙ্গোপোসাগরে এসে উপস্থিত। বহরে আছে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ; ৭৫টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান F-4 Phantom II বহন করে আসছিল। সঙ্গে আছে পারমাণবিক বোমা। শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানে আটকে পরা ১৯৪ নাগরিক কে উদ্ধারের কথা বললেও সময়ের সাথে সাথে মার্কিনীরা খোলস খুলে বেড়োয়। “রক্তপাতের সম্ভাবনা” দেখা দেওয়ায় এখন তারা পাকিস্তানী সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকদেরও উদ্ধার করতে চায়।
দোরগোড়ায় সপ্তম নৌবহরের আবির্ভাবে পাকিস্তান খানিকটা স্বস্তি পায়। তাদের ধারণা – মার্কিনীদের উপস্থিতি দেখে মিত্রবাহিনী বোধহয় ভড়কে যাবে। পরমাণু বোমার ভয়ে, কিংবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না আবার বেঁধে বসে সেই আশঙ্কা থেকে হলেও ভারত হয়ত নমনীয় হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নিয়াজীকে “প্রয়োজন হলে” যুদ্ধবিরতির কথা বিবেচনা করতে বলে। নিয়াজী সেই মতে আশায় বুক বেঁধে ভারত বাহিনী-প্রধান মানেকশ কে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব দেয়। “ভারত আত্মসমর্পণে বাধ্য না করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আপাতত কোথাও সটকে পরার সুযোগ দিক, পরে সুস্থির মত তারা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমাবে” – মানেকশ’র কাছে আবদার জুড়ে বসে নিয়াজী।
ঢাকা প্রবেশের সব পথ ইতোমধ্যে মিত্রবাহিনীর দখলে। নরসিংদী থেকে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে ঢাকায় আসছে মুক্তিবাহিনী। মিত্রবাহিনীর মানসিংয়ের নেতৃত্বে আরেক দল সাভারের নবীনগর হয়ে ঢাকায় ঢুকছে। মুক্তিবাহিনীর বিজয় চোখের সামনে। এমন সময় কীসের যুদ্ধবিরতি? মার্কিনীরা পাকিস্তানের হয়ে লড়বে? চীন তার সৈন্য দিয়ে ভারতের সীমান্তে আক্রমণ করবে?
আসুক মার্কিনীরা, আসুক চীনারা! মা ভৈঃ!
জেনারেল মানেকশ স্পষ্ট বলে দিলেন – নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোন কথাই শোনা হবে না। মিত্রবাহিনীর পক্ষ হতে সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৫টা থেকে পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার ওপর বিমান হামলা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন তিনি। এর মধ্যে পাকিস্তানকে আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নিতে হবে। নাহলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার পর প্রবল আক্রমণ শুরু হবে।
সংহার মূর্তিতে দুয়ারে দাঁড়িয়ে মুক্তিবাহিনী। আত্মসমর্পণ না করলে পাকিস্তান বাহিনীর ধ্বংস ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। নিয়াজীর প্রস্তাবে মানেকশ’র প্রত্যুত্তরঃ
‘…পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে কি না, তা জানানোর জন্য বিশেষ বেতার কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং কোড নম্বর দেওয়া হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টার মধ্যে শর্তহীন আত্মসমর্পণ না করা হলে ফের বিমান হামলা শুরু হবে। ভারত বা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হবে…’
তথ্যসূত্রঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র
যুগান্তর (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১)
‘৭১ এর দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী