বাংলাদেশ কিভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘হাইব্রিড উপনিবেশে’ পরিণত হল?

ঐতিহাসিকভাবে, ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক প্রভাব ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিরোধ করতে ‘ইসলাম’কে একটি অস্ত্র হিসেবে দেখে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামপন্থী দল হিসেবে, সোভিয়েতপন্থী সমাজতন্ত্র ও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করত। ফলে, মার্কিন গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক মহলে জামায়াতকে আদর্শিক মিত্র হিসেবে দেখা হতো।

১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে সমর্থন করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও জামাত তথা রাজাকার আলবদর পরিবার মিলে একটি অশুভ জোট গড়ে তোলে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন (ইসলামী ছাত্র সংঘ) সরাসরি পাকিস্তানি সেনার সহযোগী হিসেবে আল-বদর/আল-শামস গঠন করে গণহত্যায় অংশ নেয়।

১৯৭৫ এর শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড নয়া-উপনিবেশিক পর্বের সূচনা করে। ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রথম স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদর পরিবারের বুদ্ধিজীবী হত্যার ফল দিতে শুরু করে; ইসলামপন্থীদের পুনর্বাসন শুরু হয়। জামায়াত নেতারা নির্বাসন থেকে দেশে ফেরে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে সরিয়ে ‘ইসলামীকরণ’ শুরু হয়। এই সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামপন্থী প্রভাব বাড়তে থাকে।

১৯৮০ এর দশকে শুরু হয় ইসলামপন্থীদের ‘সমাজ দখলের‘ প্রকল্প। এরশাদের শাসনে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা হয় (১৯৮৮)। ইসলামপন্থী এনজিও (জামায়াত সংশ্লিষ্ট), মাদ্রাসা, ইসলামি ব্যাংকিং, ওয়াজ মাহফিল, দাওয়াহ মুভমেন্ট সমাজে প্রভাব বাড়াতে থাকে। মার্কিন প্রশাসন তখন ইসলামপন্থীদের “অ্যান্টি-কমিউনিস্ট বন্ধু” হিসেবে নতুনকরে গুরুত্ব দিতে থাকে। পাকিস্থানি আইএসআই থাকে পেছনে, গোপনে।

১৯৯১-২০০১ এর সময়কালে গণতন্ত্রের নামে ইসলামোফ্যাসিবাদের বৈধতা দিতে বিএনপি-জামায়াত জোট গঠিত হয়। জামায়াত সরকারে অংশ নেয়।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে জামায়াতকে “মডারেট ইসলামিস্ট” হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, মার্কিন নেতৃত্বে। সমাজের ভেতরে ধর্মীয় চেতনার নামে ‘ইসলামি জাতীয়তাবাদ’ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার কৌশল হয় ‘শুক্রবারের মুসলমান’ ও হিজাব বোরখার প্রসারে। বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এবং একই সাথে সাধারণ মানুষের লোকজ আধ্যাত্মিক ‘ধর্ম ইসলাম’ এর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিত হতে থাকে।

২০০১-২০০৬ কালপর্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ৯/১১ এর কারণে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করে। একদিকে ইসলামী জঙ্গিবাদ বিরোধিতা, কিন্তু অন্যদিকে জামাতকে পৃষ্টপোষকতা করে। এর ফলে বাংলাদেশে তৎকালীন জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ ও নিজামী মন্ত্রিত্বে থাকে। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

২০০৯–২০১৫ সময়কালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবী সামনে চলে আসে, যার প্রধান ভূমিকায় ছিলেন জাহানারা ইমাম। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জামায়াত নেতাদের বিচার করে, কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে জামাতকে নিষিদ্ধ করেনা। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিকভাবে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো দ্বৈত অবস্থান নেয়। একদিকে নৈতিক সমর্থন, অন্যদিকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ সমালোচনা শুরু করে। কিছু ‘বাম’ এই সমালোচনায় যুক্ত হয়। আওয়ামীলীগ হেফাজতে ইসলাম এর উত্থানে ভূমিকা রাখে।

২০১৪–২০২৪ এই দশ বছরে লিবারেল ‘গণতন্ত্রের’ গভীর সংকট দেখা দেয়, বাংলাদেশের ক্রনি পুঁজিবাদের কারণে জন্ম নেয়া দুর্নীতিবাজ পুঁজিপতি শ্রেণীর বিকাশের ধারায়। ইসলামপন্থীদের সামরিক শাখার (জঙ্গিবাদ) বিরুদ্ধে আইনি কঠোর অবস্থান থাকলেও কৌশলগত সহযোগিতা অব্যাহত থেকে যায়। যেমন ইসলামী শিক্ষাক্রমকে মেনে নেওয়া।

ঢাকার গণভবন অভিমুখে বিক্ষোভকারীদের পদযাত্রায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের পতাকা এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছিল, সাথে ছিল সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ।
ঢাকা, ৫ আগস্ট ২০২৪, বিক্ষোভকারীদের পদযাত্রায় জঙ্গি সংগঠন আই,এস,আই-এর পতাকা, সাথে সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ। (সূত্র: গেটি ইমেজ)

২০২৪ এর রেজিমচেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে জামায়াতের সশস্ত্র পদক্ষেপে ক্ষমতা দখল পর্ব সম্পন্ন হয়। ফলে ২০২৫ সালে চূড়ান্ত রূপে ‘হাইব্রিড উপনিবেশ’ প্রতিষ্ঠা পায়। মার্কিন সৈন্যের পদচারনায়, মার্কিন নিয়ন্ত্রিত কোম্পানির হাতে চট্টগ্রাম বন্দর তুলে দেয়ার মাধ্যমে, নতুন যুগের সূচনা ঘটে।

বাংলাদেশ কীভাবে ‘হাইব্রিড উপনিবেশে’ পরিণত হলো? সহজ কথায়, একটি অনন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও, ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বায়ন, সাম্রাজ্যবাদী নয়া-উদারবাদী উন্নয়ন নীতি, দেশীয় সামরিক আমলা, দুর্নীতিগ্রস্থ পুঁজিবাদী শ্রেণি ও রাজনৈতিক ইসলামের একটি যৌথ দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্কের বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ক্রমে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী রাজাকার আলবদর পরিবারের সাথে সহাবস্থান করতে বাধ্য হয়। যার চূড়ান্ত রূপ আজকের মৌলবাদ নিয়ন্ত্রিত সমাজ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি – হাইব্রিড উপনিবেশ।

Tags :

A R Khan Asad

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025