বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের একটি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ঘিরে দেশজুড়ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রস্তাবিত একটি “মানবিক করিডোর” মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবহার করার অনুমতি দিতে পারে। সেখানে বর্তমানে বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি নামক সশস্ত্র জাতিগত গোষ্ঠী। সরকারের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে এটি কেবল একটি মানবিক প্রচেষ্টা। তবে দেশের মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের বড় অংশ একে দেখছেন সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস এবং এক ধরনের কূটনৈতিক আত্মসমর্পণ হিসেবে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্যান্য দেশের একইধরনের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য ফলাফল বিশ্লেষণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
সিরিয়া: মানবিক করিডোরের নাম করে নিয়ন্ত্রণ এবং পুনর্দখল, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এক দশকের বেশি সময় ধরে চলেছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে জটিল ও সহিংস দ্বন্দ্বগুলোর এটি একটি। এই সংঘাতে, সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমাগত লড়াই হয়েছে। ২০১৬ সালে আলেপ্পো শহরের পূর্বাংশে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোয় সিরিয়া ও রাশিয়া যৌথভাবে “মানবিক করিডোর” ঘোষণা করে। সরকার দাবি করে, তারা এই পথগুলো খুলছে যেন সাধারণ জনগণ নিরাপদে এলাকা ত্যাগ করতে পারে এবং বিদ্রোহীরা অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করতে পারে।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল অনেক ভিন্ন। আলেপ্পোর করিডোরগুলোকে ঘিরে বিদ্রোহীদের অবরুদ্ধ করা হয়। যাদের বলা হচ্ছিল সাধারণ মানুষ, তাদের অনেককেই সশস্ত্র বলে সন্দেহ করে গ্রেফতার করা হয়। বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। বলা যায়, এই করিডোরগুলো মানবিকতার চেয়ে রাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। এমন করিডোরের মাধ্যমে সিরিয় সরকার যুদ্ধ না করেই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা পুনর্দখল করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেইসময় অনেকটাই নীরব দর্শক ছিল।
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো: করিডোরে চোরাচালান ও বিদ্রোহী অর্থায়ন ডি.আর. কঙ্গোতে বহু দশক ধরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো পূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত এলাকায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো এসব এলাকায় খাদ্য, ওষুধ ও শিক্ষা সামগ্রী পৌঁছে দিতে চাইলেও, তাদের প্রথমে সেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অনুমতি নিতে হয়। বাস্তবে দেখা গেছে, এসব করিডোর ব্যবহার করে বিদ্রোহীরা কর আদায় করে, লুটপাট করে এবং বিদেশি সাহায্যদাতাদের দিক থেকে নিজেদের বৈধ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।
এমন এক সময় ছিল যখন জাতিসংঘও বিদ্রোহীদের সাথে সমঝোতা করে করিডোরের মাধ্যমে ত্রাণ পাঠাতো। তবে এতে সমস্যার সমাধান হয়নি বরং আরও জটিলতা তৈরি হয়। বিদ্রোহীরা এসব সাহায্যের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে, এমনকি নিজেদের সেনা সদস্যদের মজুরি পর্যন্ত এই তহবিল থেকে দেয়। এমন একটি বাস্তবতা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় দেখা দিলে, পরিস্থিতি হতে পারে বিপজ্জনক। বিশেষ করে, যখন সীমান্তে এর আগেও চোরাচালান, মানবপাচার এবং অস্ত্র পরিবহনের ইতিহাস রয়েছে। আরাকান আর্মি করিডোরের মাধ্যমে নিজস্ব কাঠামো শক্তিশালী করতে পারবে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
ইথিওপিয়া: টিগ্রায় সংঘাত ও করিডোর ব্যর্থতা ইথিওপিয়ার টিগ্রায় অঞ্চলে ২০২০ সালে সংঘাত শুরু হলে সরকার এবং টিগ্রায় পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (TPLF) এর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। এই সময়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা খাদ্য ও ওষুধ পৌঁছাতে সরকারের সাথে করিডোর খোলার জন্য আলোচনা চালায়। শুরুতে কিছু অংশে করিডোর খোলা হলেও, তা ছিল সীমিত এবং অনিয়মিত। সরকারের শর্ত ছিল, করিডোরের মাধ্যমে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঞ্চলে, নির্দিষ্ট পয়েন্টে সাহায্য যাবে। বিদ্রোহী পক্ষের দাবি ছিল, সরকার সাহায্য আটকে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে এবং লাখো মানুষ দুর্ভিক্ষে পড়ে। মূলত, করিডোরের কার্যকারিতা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আন্তরিকতার উপর। ইথিওপিয়ায় সেটির অভাব ছিল, আর তাই করিডোর কার্যকর হয়নি বরং দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরাকান আর্মির ওপর কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। করিডোর খোলার পর যদি তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলে ত্রাণের অপব্যবহার, চোরাচালান, এমনকি সীমান্ত অঞ্চলে নতুন শরণার্থী ঢলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
দক্ষিণ সুদান: করিডোরে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন দক্ষিণ সুদানে ২০১৩ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সরকার ও বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে দেশটি দ্রুত একটি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। জাতিসংঘ, রেডক্রস এবং অন্যান্য সংস্থা সাহায্য পাঠাতে চায়, এবং সরকার করিডোর খোলার অনুমতি দেয়। কিন্তু সেই করিডোর ছিল চুক্তিভিত্তিক এবং অস্থায়ী। সাহায্য পৌঁছানো মানেই ছিল বিদ্রোহীদের চাঁদা প্রদান বা সশস্ত্র পাহারার ব্যবস্থা করা। সাহায্যকর্মীরা প্রায়শই সহিংসতার মুখে পড়ে, ত্রাণবাহী গাড়ি নিয়মিত লুট হতে থাকে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাহায্য পৌঁছানোর আগেই তারা সেগুলো বিক্রি করে দিত। যেহেতু সেখানে জাতিসংঘের নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রায় অসম্ভব ছিল, তাই প্রায় কোন অপরাধই নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
এই ঘটনাগুলো দেখিয়ে দেয়, মানবিক করিডোর খোলা মানেই কাজ হবে এমন নয়। পক্ষগুলো যদি সহিংস এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়, তাহলে করিডোর হয় আরেকটি যুদ্ধক্ষেত্র। বাংলাদেশের সীমান্তে যদি এই করিডোর আরাকান আর্মির সহায়তায় খোলা হয়, তাতে সাময়িকভাবে কিছু ত্রাণ পৌঁছাতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে সীমান্ত অঞ্চলটি হয়ে উঠতে পারে অস্থিতিশীল, সহিংস এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এই করিডোরকে উপস্থাপন করছে আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন হিসেবে। তারা বলছে, জাতিসংঘের আহ্বানে তারা সহযোগিতা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীসের বিনিময়ে? আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিকভাবে একটি সশস্ত্রবিদ্রোহী গোষ্ঠী। তাদের কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই, তারা রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার বাহিনীর সাথে লড়ছে এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলে একাধিকবার অস্থিরতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ যদি এই গোষ্ঠীর জন্য করিডোর খোলে, তাহলে সেটি তাদের প্রতি একটি পরোক্ষ স্বীকৃতি।
আমাদের মনে রাখতে হবে এই অঞ্চলটি সীমান্তবর্তী অপরাধ—বিশেষত মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের জন্য পরিচিত। রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘর্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর আগে, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মোঃ তৌহিদ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “জাতিসংঘ রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশ হয়ে একটি মানবিক করিডোর গঠন করতে চায়। সরকার শর্তসাপেক্ষে নীতিগতভাবে তাতে সম্মত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমারের পুরো সীমান্ত এখন একটি অ-রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেখানে মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের (জুন্টা) কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সুতরাং, নিজেদের স্বার্থেই আমাদের তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখা যায় না। কিন্তু আমরা চাইলেও তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব নয়।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “জাতিসংঘের মতে, রাখাইন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক ঘাটতির শঙ্কা দেখা দিচ্ছে সেখানে।” তিনি বলেন, “হ্যাঁ, সীমান্তে সক্রিয় অপরাধী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী করিডোরের সুযোগ নিয়ে এলাকা আরও অস্থির করতে পারে। আমাদের দুইটি বিষয় আগে সমাধান করতে হবে – (১) নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল ঠেকানো, (২) যারা ইতোমধ্যে এসেছে তাদের প্রত্যাবাসনের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা।”
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায় থেকে করিডোর খোলার বিরোধিতা এসেছে। সামরিক মহলের আশঙ্কা, যে করিডোরটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং এটি “নন-স্টেট অ্যাক্টর”-কে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার শামিল হবে। সেনাবাহিনী সূত্রে জানা যায়, সীমান্তে এমন একটি করিডোর আরাকান আর্মিকে বাংলাদেশে স্থায়ী উপস্থিতির সুযোগ করে দিতে পারে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীপ্রধান করিডোরের বিরোধিতা করেছেন এবং প্রকাশ্যে তাঁর উদ্বেগ জানিয়েছেন বলে সেনা সূত্রগুলো ইঙ্গিত দিয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে সামরিক ও রাজনৈতিক অনাস্থা তৈরি করতে পারে। এর মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খালিলুর রহমান, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও রাখেন, তিনি করিডোর উদ্যোগের প্রবক্তা হিসেবে সামনে এসেছেন। ফলে জনগণের একাংশ তাঁর দেশপ্রেম ও পক্ষপাত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এই সিদ্ধান্তকে “সার্বভৌমত্ববিরোধী” বলে আখ্যা দিয়েছে এবং সরাসরি খালিলুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে তাঁকে “জাতীয় বিশ্বাসঘাতক” বা “প্রক্সিকূটনীতিক” বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাংলাদেশের স্থায়ী স্বার্থের চেয়ে বিদেশি প্রভাবের প্রতি অধিক নমনীয়।
জাতিসংঘের চ্যানেলের মাধ্যমে কোনো দেশকে ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য এবং সামাজিক সম্পৃক্ততা জরুরি, বলেছেন নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র বিশ্লেষকরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, “এই পথ নিরাপদে ব্যবহার এবং জাতিসংঘের এই পরিকল্পনার সফলতা কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এখানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, আরাকান আর্মি ও জাতিসংঘ, এই চার পক্ষকে করিডোর বিষয়ে একমত হতে হবে এবং একে অপরের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। যদি এক পক্ষও অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, বাংলাদেশকে এই পরিকল্পনায় এগোনো উচিত নয়।” তিনি আরও বলেন, “আমরা বলতে পারি না রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা কবে থামবে, কিন্তু এটা অনুমান করা যায় করিডোরটি দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। আর যদি অস্থায়ী সরকার মানবিক কারণে এটি অনুমোদন করতে চায়, তাহলে ভবিষ্যতে যারা সরকার গঠন করবে, অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে পরামর্শ করা জরুরি। তাদের সমর্থন ছাড়া কোনো চুক্তি সফল হবে না।”
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইস বলেছেন, রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশ হয়ে করিডোর গঠনের বিষয়ে জাতিসংঘ কোনো আলোচনায় অংশগ্রহণ করছে না। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ডিক্যাব আয়োজিত অনুষ্ঠানে (ডিক্যাব টক) সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এই মন্তব্য করেন। রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর গঠনের বিষয়ে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে গুইন লুইস বলেন, “সংঘাত-প্রবণ অঞ্চলে মানুষের সহায়তায় বা সীমান্ত সহযোগিতা বাড়াতে যেকোনো উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই এবং জাতিসংঘ সবসময় প্রস্তুত থাকে। তবে বর্তমানে কোনো করিডোর গঠিত হয়নি এবং আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনায় নেই।” তিনি আরও বলেন, “যদি কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি থাকে, জাতিসংঘ সহযোগিতা করতে পারে। তবে আমার জানা মতে, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো চুক্তি হয়নি।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাখাইনে প্রবেশ করাটা খুব কঠিন, কারণ সেখানে সংঘাত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তিনি জানান, বর্তমানে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটার এলাকায় আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ এলাকা তাদের দখলে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বার্মিজ সংবাদমাধ্যম নারিঞ্জারাকে জানিয়েছেন, আরাকান আর্মিকে বাদ দিয়ে রাখাইন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যদিও ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর-এর মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে একটি সহায়তা চুক্তি রয়েছে, তবে জাতিসংঘের উপস্থিতি সেখানে অনেক কমে গেছে। কিছু কর্মকর্তা এবং অংশীদার এখনো সক্রিয় রয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে মানবিক করিডোরের ইতিহাস স্পষ্ট করে দেখায়, এটি এক জটিল এবং দ্বিমুখী ব্যবস্থা। সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না হলে, করিডোর পরিণত হয় অস্ত্রধারীদের রসদ পথ হিসেবে, জনগণের দুর্ভোগের উৎস হিসেবে এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হারানোর সংকেত হিসেবে। সিরিয়া, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান প্রত্যেক ক্ষেত্রেই করিডোর ছিল রাজনৈতিক কৌশল, যা বিদ্রোহীদের সহায়তা করেছে এবং সরকারের অবস্থান দুর্বল করেছে। বাংলাদেশ যদি এই ভুল পথে পা বাড়ায়, তবে তা হবে শুধু রাজনৈতিক অগ্রহণযোগ্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, জনমত এবং সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি আঘাত। দেশের জনগণের বিপরীতে গিয়ে নেওয়া এমন কোনো সিদ্ধান্ত স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। এই রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের মধ্যে করিডোর একটি জাতীয় সংকটের রূপ নিতে যাচ্ছে। একদিকে জনগণের প্রবল আপত্তি, অন্যদিকে একজন বিদেশি নাগরিকত্বধারী নিরাপত্তা উপদেষ্টার দৃঢ় অবস্থান, এই দুইয়ের সংঘর্ষে জাতীয় ঐক্যপ্রশ্নের মুখে পড়েছে। যখন জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির মতো সংবেদনশীল বিষয়ে স্পষ্ট রাজনৈতিক ঐক্য অনুপস্থিত থাকে, তখন যেকোনো পদক্ষেপ শুধুমাত্র কূটনৈতিক ব্যর্থতাই নয়, জাতীয় বিভক্তির সূচক হয়ে উঠতে পারে। করিডোরের নাম করে যদি অস্থিতিশীলতার বীজ বোনা হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এর মূল্য দিতে হতে পারে।
তথ্যসূত্র:
1. UN OCHA Reports on Humanitarian Corridors – Syria, Ethiopia, South Sudan
2. International Crisis Group reports on DR Congo and Arakan Army
3. Al Jazeera, The Guardian, BBC Reports (2020–2024)
4. Dhaka Tribune, Prothom Alo, The Daily Star – report on Khalilur Rahman controversy, 2025