কথা বলতে না দিলে মেরে ফেলেন : আদালতে সাবেক সিইসি

আদালতে কথা বলতে গিয়ে বাধা পাওয়ায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, তাকে যেন একটি রিভলবার দিয়ে ‘মেরে ফেলা হয়।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক শামসুজ্জোহা সরকার বৃহস্পতিবার সাবেক সিইসিকে আদালতে তুলে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান তিন দিনের রিমান্ড দেন।

রিমান্ড শুনানির সময় বিচারকের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন সাবেক সিইসি। কথা বলার এক পর্যায়ে মহানগর পিপি ওমর ফারুক ফারুকী তাকে কথা বলতে বাধা দিলে হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমাকে কথা বলতে না দিলে একটা রিভলবার দিয়ে আমাকে মেরে ফেলেন।

দুপুর দেড়টার দিকে বিচারক এজলাসে ওঠেন। বিচারকের উদ্দেশে হাবিবুল আউয়াল তখন কিছু বলতে চান। তখন বিচারক বলেন, একটু পরে শুনব আপনার বক্তব্য।

পিপি ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। শুনানিতে তিনি বলেন, আজকের আসামি ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পদে ছিলেন। ওই সময়ে গত বছরের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচনকে কলঙ্কিত করেছেন। ফ্যাসিস্ট সরকার ও আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছেন। যারা ইতিমধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা এসেছিল তারা কেউ ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। তারা আগেই জেনেছিল এটা প্রহসনের নির্বাচন। আসামি ওই সময়ে গর্ব করে বলেছিলেন, কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও আমি নির্বাচনী কাজ চালিয়ে যাব। এই ধরনের বক্তব্য তিনি কীভাবে বলতে পারেন।

শুনানিতে তিনি আরও বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে; মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোট দিয়েছে- এত বড় মিথ্যা কথা তিনি কীভাবে বললেন। ভোটের দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, সকাল ৮ থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৭% ভোট পড়েছে। ওইদিন দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভিডিওতে দেখে গেছে ভোটকেন্দ্র কুকুর-বিড়াল ছাড়া আর কেউ নেই। ঘণ্টাখানেক পরে আবারও মিডিয়াতে এসে তিনি বলেন, ৪০% ভোট পড়েছে। উপস্থিত সাংবাদিকদের একজন তাকে (আসামিকে) প্রশ্ন করেন, এই এক ঘণ্টা আপনি কোথায় ছিলেন? তখন এই উত্তরে তিনি বলেন, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, শেখ হাসিনার সাথে আঁতাত করে তিনি এসব কাজ করেছেন। নির্বাচনের নামে বিভিন্নভাবে অন্যায় প্রভাব খাটিয়েছেন। টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। মানুষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছেন। তিনি দেশের জণগণের ক্ষমতাকে হরণ করেছেন। গত ৫ আগস্টের পর তিনি আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন। এরপর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আসামি পক্ষের আইনজীবী ইয়ামিন হাসান রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন শুনানি করেন। তিনি শুনানিতে বলেন, আসামির ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স। অনেকগুলো অসুখ-বিসুখ রয়েছে। আমি বেশি কথা বলব না, ফ্যাসিস্ট দমন করতে গিয়ে আমরা যেন ফ্যাস্টিস সৃষ্টি না করি।

এরপর সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল আদালতের অনুমতি নিয়ে বলেন, আমার জীবনে কোনো দিন কেউ অর্থ আত্মসাৎ বা দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। আমি ডামি বা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন প্রহসনের সঙ্গে জড়িত নই। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমাকে কেউ পয়সা দেয়নি বা আমি কারও কাছ থেকে পয়সা নেয়নি।

এসময় বিচারক বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তার যারা সহযোগী থাকেন তারা অতীতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার অধিক পায়নি। আপনার সময়ে তাদের পারিশ্রমিক বহুগুণ বৃদ্ধি করে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনার কোন দায়িত্ব ছিল কি না? এবারের নির্বাচনের সময় আমি একটা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক ছিলাম, অথচ আমাকে দায়িত্ব না দিয়ে অন্য এক জনকে দেওয়া হয়েছিলো। তারা প্রত্যেকেই ৫ লাখ টাকা করে বিল তুলেছে।

তখন হাবিবুল আউয়াল বলেন, এত টাকা বিল পাওয়ার কথা আমার জানা নেই। একটি নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রায় ৮ লাখ লোক যুক্ত থাকে, তাদের কাউকে আমি চিনিও না।

এরপর বিচারক বলেন, আপনার সময় আপনি দেশসেরা অফিসার ছিলেন। নির্বাচনে অনৈতিকতা দায় নিয়ে কেন আপনি পদত্যাগ করেননি?

উত্তরে সাবেক সিইসি বলেন, পদত্যাগ করলে ভালো হতো। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের অধীনে অতীতে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। তখন কি নির্বাচন কমিশনারগণ পদত্যাগ করেছেন? দলীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচনই বিতর্কিত। শেখ মুজিবও ক্ষমতার লোভ সামলাতে পারেনি। দলীয় সরকারের অধীনে সব নির্বাচনই বিতর্কিত। কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া রাজনৈতিক সরকারের অধীনে আগামী এক হাজার বছরেও কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।

এ সময় মহানগর পিপি ওমর ফারুক ফারুকী তাকে কথা বলতে বাধা দিলে হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমাকে কথা বলতে না দিলে একটা রিভলবার দিয়ে আমাকে মেরে ফেলেন।

পরে আরও কথা বলতে চাইলে বিচারক তার তিনদিনের রিমান্ডের আদেশ দেন।

বুধবার রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে হাবিবুল আউয়ালকে গ্রেপ্তার করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। একই মামলায় গত ২৩ জুন নুরুল হুদার চার দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন ঢাকার একটি আদালত।

দশম থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ‘প্রহসনের’ মাধ্যমে আয়োজন ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গত ২২ জুন বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন খান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় এই মামলা করেন। মামলায় সাবেক তিন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কে এম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ ২৪ জনকে আসামি করা হয়। পরে মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ধারা যুক্ত করা হয়।

২০২২ সালে সিইসির দায়িত্ব নেওয়া হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর তিনি অন্য কমিশনারদের সঙ্গে নিয়ে পদত্যাগ করেন।

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

 People’s Agenda

Quick Links

Copyrights are reserved by NE News © 2025