কোলকাতার বামপন্থীরা সেসময় গুজব রটিয়ে স্বাধীনতাকামীদের মন ভেঙে দিচ্ছিল

১৯৭১ সালের আগস্টে ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তির গুরুত্বটা পরে টের পাওয়া গেলো। জুলফিকার আলী ভূট্টো আগ বাড়িয়ে গণমাধ্যমে বললেন, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে তাদের অকৃত্রিম বন্ধু চীন পাশে এসে দাঁড়াবে এবং তাদের সৈন্যরা এসে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করবে।

ভারতের চালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মঙ্গোলিয়া সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করে। মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে চীনের সীমান্ত। এর মানে হচ্ছে চীন পাকিস্তানে সৈন্য পাঠালে সোভিয়েত সৈন্য চীনে ঢুকবে! রাজনীতির দাবা খেলায় ভারতের ঘোড়া চালে চীন তার সৈন্য পাকিস্তানে পাঠাবে কি, নিজের নিরাপত্তার জন্য সৈন্য পিছিয়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলো। ফলে পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতকে জব্দ করতে চীনের সহায়তা আর পেলো না। সেদিন এই খবরটি মুজিবনগর সরকারে আনন্দ বয়ে এনেছিল।

আরো একটি বড় ঘটনা ছিল ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি। এই প্রথম বিশ্ব মানচিত্রে ভারত ‘বাংলাদেশ’ নামে কোন দেশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করল। দিল্লি গিয়ে তাজউদ্দীন-নজরুল ইসলাম ভারত সরকারের সঙ্গে এই চুক্তি ছিল বাংলাদেশ নামের দেশটিকে ভারত সরকারের অঘোষিত স্বীকৃতি। এটা আগস্ট মাসের ঘটনা। কোলকাতা ফিরে সেদিন তাজউদ্দীনের সঙ্গে সকলের কোলাকুলি হয়েছিল যুদ্ধ জয়ের মত। কারণ এবার ভারত সরাসরি প্রকাশ্যে যুদ্ধে যোগ দিবে।

কিন্তু খুশির মাঝেই খবর বের হলো মার্কিন সপ্তম নৌবহর রওনা হয়েছে বঙ্গপোসাগরের উদ্দেশ্যে। এই খবরে সবার মুখ শুকিয়ে গেলো। তাজউদ্দীনের কোলকাতা অফিসে কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের শংকার কথা জানালে তিনি বলেন, আসুক ওরা। আমরা তো আর একা নই। ভারত ও সোভিয়েত নেভী ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে ঢোকার মোহনা মুখে মাইন পেতে রেখেছে। ওরা আস্ত ফিরে যেতে পারবে না…।

সত্যি সত্যি ভারত-সোভিয়েত সমুদ্রের নিচে পোঁতা মাইনের জন্য আর সপ্তম নৌবহর আসতে পারেনি।

কোলকাতার বামপন্থীরা সেসময় ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি নিয়ে কী রকম গুজব রটিয়ে স্বাধীনতাকামীদের মন ভেঙে দিচ্ছিল তার কিছু কথা জানিয়েছেন মুজিবনগর সরকারের গণসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। কোলকাতার বামরা বলাবলি করতো, ভারতীয় বাহিনীর যেসব সৈন এখন বাংলাদেশে যাবে এরা কোনদিন আর ফিরে আসবে না। এরা চিরস্থায়ীভাবেই বাংলাদেশে থেকে যাবে। এর ফলে চীন তোমাদের দেশেই সামরিক অভিযান চালাবে। আর তোমাদের মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে চীনের বিরুদ্ধে লড়বে। তোমাদের স্বাধীনতার দাবী পড়ে যাবে চাপা। তোমাদের স্বাধীনতাও অনিশ্চিত হয়ে যাবে…।

নিজ দেশের সরকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই রকম গুজব কেবল চিঙ্কু বামেরাই পারে!

৩ ডিসেম্বর কোলকাতায় আসবেন ইন্দিরা গান্ধী। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইন্দিরা কোলকাতার আসার খবরে শরণার্থী ও মুজিবনগর সরকারের মধ্যে একটা আনন্দ অশ্রু বয়ে গেলো। যেন কী একটা আসন্ন সুখবর তারা পেতে যাচ্ছে। সারা কোলকাতা তখন ইন্দিরার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কি বলবেন তিনি সবাই শুনতে অধীর হয়ে আছে। গড়ের মাঠের দিকে মিছিল নিয়ে যাচ্ছে এপাড় বাংলার শরণার্থীরা, শ্লোগান দিচ্ছে, ‘ইন্দিরা তুমি এগিয়ে চলো, মুজিব বাঁচাও, বাঙালি বাঁচাও’ ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ ‘এক বাংলা একদেশ, বিশ্ব কবির সোনার বাংলা মুজিব-নজরুলের বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’!

ইন্দিরা এলেন, স্বাধীনতাকামী জনতা, শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা যারা এদেশে এসেছো তারা আমার সন্তানের মত, ভাই-বোনের মত। তোমাদেরকে আমি নিরাপদেই স্বদেশে পাঠাবো। কোন বধ্যভূমিতে পাঠাবো না। আমাদের একটা মানবতাবোধ দায়িত্ববোধ আছে। আমরা এই দায়িত্ববোধ থেকে পিছু হটে যেতে পারি না। তোমরা নিশ্চিত থাকো আমি তোমাদের স্বাধীন দেশেই পাঠাবো নিরাপদে। যেন তোমরা মালসামান নিয়ে স্বাধীন দেশে যেতে পারো সব ব্যবস্থা করে দিবো। তোমাদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা কথা হয়েছে।…

ইন্দিরার সেদিনের এই আশ্বাস সুখবর স্বাধীনতাকামী জনতকাকে ভরসা দিয়েছিল। ইন্দিরা যে মিথ্যে স্বপ্ন দেখাননি তার মাত্র ১৩ দিন পরই মানুষ চাক্ষুস করেছিল। ইন্দিরা সেদিন তার ভাষণে আরো বলেছিলেন, অনেক ইচ্ছে ছিল তোমাদের সুখ দুঃখের কথা একান্তে শুনবো। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই আক্রান্ত। পাকিস্তান আক্রমন করেছে আমাদের। আমি কথা দিচ্ছি তোমাদের নেতা শেখ মুজিবকে আমরা ফিরিয়ে আনবো। আবার তোমাদের সঙ্গে কথা হবে মেরা ভাই আওর বহিন…’

৩ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো আক্রান্ত হবার পর। এই খবরে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা, মুজিবনগর সরকার, সাধারণ শরণার্থী, কোলকাতাবাসীর মাঝে উত্তেজনা আশা ভরসা খুশির মিলিত এক স্রোত বয়ে গিয়েছিল। এতদিন কেবল সবার মুখে এক কথা- ভারত কেন যুদ্ধ ঘোষণা করছে না…কবে দেশে ফিরবো… ভারত কেন কিছু করছে না…

তারপর ডিসেম্বরের বাকী দিনগুলো কেবলই বিজয়ের সংবাদ। ১৬ ডিসেম্বর রেডিওতে ভারতীয় সেনা প্রধানের ঘোষণা বাজছিল, আত্মসমর্পন করতে। ভারতীয় বিমান ঢাকার আকাশে উড়ছিল। শুধু বেছে বেছে পাকিস্তানী সৈন্য ঘাঁটিতে বোমা হামলা করছিল। জনতা ছাদে উঠে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে যেন ভারতীয় বায়ুসেনাকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছিল। বিমান থেকে উর্দুতে আত্মসমর্পনের লিফলেট ছড়ানো হচ্ছিল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে জেনেভা কনভেশনের আওতায় নিরাপদ স্থান ঘোষণা করা হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যরা জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল। আত্মসমর্পনের খবর যখন রেডিওতে ঘোষিত হলো তখন ঢাকাবাসী সবাই ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। আজ থেকে তারা স্বাধীন, মুক্ত…। সেই থেকে ডিসেম্বর মাসটা আমাদের বিজয়ের মাস।

ঠিক একই কারণে এই ডিসেম্বর মাস আসলেই পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধীদের কেবলই অস্বস্তি বিরক্তি বিকৃতি’র লক্ষণ দেখা দেয়। এই মাস এলেই এদের মানসিক স্বাস্থ্য শোচনীয় হতে থাকে। যে করেই হোক বাংলাদেশের বিজয়কে বিতর্তিক করাই তখন তাদের লক্ষ্য। আপনার আশেপাশে এরকম ছুপা বিকৃতকারীদের এই ডিসম্বরে চিনে নিন।

Tags :

Susupto Pathok

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025