বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এক অদ্ভুত, কিন্তু খুবই পরিচিত কৌশলের পুনরাবৃত্তি—Provoke-and-Exploit Strategy। রাজপথে আন্দোলনের নামে সহিংসতা, প্রতীকী অবকাঠামো যেমন মেট্রোরেল, বাস, থানায় আগুন—এসব কিছু যেন পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঘটেছে। এরপর সেই সহিংসতাকে ‘জনগণের অভ্যুত্থান’ বলে প্রচার, আর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়াকে ‘গণহত্যা’ বা ‘রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন’ বলে আখ্যায়িত করা—এই চেনা চিত্রনাট্য বারবার দেখা গেছে।
মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রকে বাধ্য করা হার্ডলাইনে (Hardline Policing) যেতে। পুলিশ যদি চুপ থাকে, তাহলে বলা হতো ‘রাষ্ট্র ব্যর্থ’, আর যদি তারা প্রতিরোধ করে, তখন বলা হয় ‘রাষ্ট্র দমনমূলক’। এভাবে সংঘর্ষ বাধানো হয়, প্রাণহানি ঘটানো হয়, এবং তারপর সেই মৃত্যুকেই হাতিয়ার বানানো হয় “Genocide” অভিযোগ তৈরিতে।
এই পুরো প্রক্রিয়া কোনো সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়—এটি একটি রাজনৈতিক থিয়েটার, যেখানে মূল চরিত্র নয়, বরং ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিপ্টই আসল খেলা। এর নাম রাজনৈতিক ভাষায় Agent Provocateur Tactic—যেখানে আন্দোলনের ভেতরে ঢুকে পরিকল্পিত উসকানিমূলক সহিংসতা ছড়ানো হয়, যাতে রাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং আন্দোলনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ বলে তুলে ধরা যায়।
এই কৌশল বাস্তবায়িত হয়েছে একটি সুপরিকল্পিত Hybrid Regime Change Attempt হিসেবে—যেখানে মিডিয়া, ধর্মীয় উত্তেজনা, সামাজিক মাধ্যম, ও আন্তর্জাতিক লবিংকে একত্রে ব্যবহার করা হয়েছে সরকার পতনের উদ্দেশ্যে। এর ভেতরে ছিল Fourth Generation Warfare—যেখানে ট্যাংক বা গুলি নয়, বরং Narrative, Disinformation, Selective outrage ব্যবহার করে রাষ্ট্র কাঠামোকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
আরও ভয়ংকর দিক হলো—এই কৌশলে প্রাণহানিকে রাজনৈতিক বিনিয়োগে পরিণত করা হয়। এটি হলো Political Sacrifice Doctrine—যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু সাধারণ নাগরিক, ছাত্র বা আন্দোলনকারী ‘বলিপাঁঠা’ বানিয়ে তুলে দেওয়া হয় আগুনে, শুধু যেন মিডিয়া একটি লাশ দেখাতে পারে। সেই লাশকে ঘিরেই আন্দোলনের ‘বৈধতা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রশ্ন উঠবেই—যদি রাষ্ট্র তার আইন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়, এবং কোনো সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটে, তাহলে কি সেটিকে গণহত্যা (Genocide) বলা যায়?
উত্তর হলো—না। Genocide হলো একটি জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম বা মতবাদকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যপূর্বক পরিকল্পিত অভিযান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিক্রিয়া দেখানোকে Excessive Use of Force বলা যেতে পারে, কিন্তু সেটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিলে তা হয় Selective Outrage এবং Weaponization of Sympathy।
বাংলাদেশে এমন False Flag Operations অতীতেও হয়েছে—যেখানে আন্দোলনের নামে আগুন দেওয়া, জান-মাল ধ্বংস, পুলিশের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, পরে দায় চাপানো হয়েছে রাষ্ট্রের ঘাড়ে। এর মাধ্যমে একদিকে সরকারকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ফেলা হয়েছে, অন্যদিকে ভেতরে ভাঙন সৃষ্টি করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—জনগণের সঙ্গে Trust Deficit না তৈরি হওয়া। উসকানি ও নৈরাজ্যের প্রকৃত উৎস, অর্থায়নকারী চক্র ও রাজনৈতিক নির্দেশনা চিহ্নিত না করা গেলে, রাষ্ট্র শুধু ক্ষত সারাবে—কিন্তু রোগ থেকে যাবে।
একইভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোরও বুঝতে হবে—রাষ্ট্রকে ভাঙা যদি ক্ষমতার সিঁড়ি হয়, তবে সেই ক্ষমতা স্থায়ী হয় না। গণতন্ত্র কখনোই নৈরাজ্যের গায়ে ভর দিয়ে আসতে পারে না।
Provoke, Exploit, Convict: শেখ হাসিনাকে পতনের পথে ঠেলে দেওয়া সেই খেলা। এই পুরো স্ক্রিপ্টের চূড়ান্ত দৃশ্য ছিল নেতৃত্ব নিধন। লক্ষ্য ছিলেন শেখ হাসিনা—বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের সফল প্রধানমন্ত্রী, যিনি একদিকে উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার প্রতীক, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।
তাকে পতনের জন্য এই পুরো Game-Plan বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উসকানি, সংঘর্ষ, আন্তর্জাতিক চাপ, ধর্মীয় মেরুকরণ, মিডিয়া ক্যাম্পেইন—সব কিছুই ছিল সেই বড় লক্ষ্য অর্জনের ধাপ।
এবং আজ, সেই কাহিনির সর্বশেষ অধ্যায় শুরু হয়েছে—Kangaroo Trial নামে পরিচিত সেই সাজানো বিচার। আন্তর্জাতিক এক ‘ট্রাইব্যুনাল’ জমা নিয়েছে ৮,৭৪৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র—যেখানে শেখ হাসিনাকে Genocide Perpetrator হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ, কোনো ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন যায়নি, কোনো স্বাধীন তদন্ত হয়নি, কোনো ভুক্তভোগীর প্রতিনিধিত্ব নেই—তবুও অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষকরা একে বলছেন Narrative Coup—যেখানে অস্ত্র নয়, বরং চরিত্রহত্যা হয় lawfare এবং disinformation এর মাধ্যমে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র রক্ষায় কঠোর হলে বলা হয় ‘Tyrant’, আর যারা আগুন ছড়ায়—তাদের বলা হয় ‘Freedom Fighter’।