বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের বেশিরভাগ কতটা বিএনপির, বিশেষ করে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা খালেদা জিয়ার জন্যে নিবেদিত, আর কতটা সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষায় ব্যস্ত—এটা নিয়ে পরিস্কার দ্বিধায় পড়ে গেছি। এই দলের বহিস্কৃত নেতা মেজর (অব) আখতারুজ্জামান রঞ্জনের বক্তব্যের পর এই সন্দেহ আরও বেশি দৃঢ় হয়েছে। তিনি খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় অবহেলার কথা বলছেন। একটি টকশোর আলোচনায় রঞ্জনের বক্তব্যকে অতিরঞ্জন মনে হয়নি, মনে হয়েছে তিনি সত্যই বলছেন।
আখতারুজ্জামান রঞ্জন বিএনপির অনুকম্পাপ্রত্যাশী নন। তিনি খালেদা জিয়াকে ‘দেশমাতা’ সম্বোধন করে কথা বলেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখে এসেছেন তিনি। দূর থেকে দেখা এসব। কেউই এখানে কাছে যেতে পারে না; সে সুযোগ নেই। তিনি দেহের আত্মার বিযুক্তির কথা বলেছেন। এটা ভয়ানক দুঃসংবাদ। এই দুঃসংবাদ কেবল বিএনপির জন্যেই নয়, এটা দেশের গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জন্যে দুঃসংবাদ।
বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি নেত্রী হলেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির দুই বটবৃক্ষের একজন। ব্যক্তি-দলীয় ও শাসক হিসেবে যত সমস্যা থাকুক না কেন খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতির অপরিহার্য দুই নাম। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু ও অব্যাহত থেকেছে। এই দুজনের ক্ষমতাচ্যুতিতে বাংলাদেশ এখন অতল অন্ধকারে নিমজ্জিত। এখন সংসদ নেই, সংসদীয় গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রে ফেরার সম্ভাবনাও নেই। বাংলাদেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে উটকো ঝামেলা সংবিধানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংবিধানকে রক্ষা করার নামে সংবিধান লঙ্ঘনের প্রাতিষ্ঠানিকতা সম্পন্ন দেশে। এখান থেকে ফেরার রাস্তা নেই। অর্থাৎ এ-দুই নেত্রীর নির্বাসন ও প্রস্থান আয়োজনের সব কার্যাদি সম্পন্নের পর বাংলাদেশ এখন দক্ষিণপন্থীদের হাতে চলে যাওয়ার উপক্রম।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রায় দিয়ে শেখ হাসিনার রাজনীতি শেষ করে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসায় অবহেলা দিয়ে খালেদা জিয়াকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ফিরে আসা ‘মিরাকল’ ছাড়া আর কিছু নয়। আবার আখতারুজ্জামান রঞ্জন যা বলছেন, তাতে মিরাকলেরও সম্ভাবনা নাই। এদিকে, তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না। তিনি স্পষ্ট বলছেন, দেশে ফেরা তার একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। আবার সরকারের লোকজন এমন কিছু করছেন, যা দরদের মতো দেখালেও ভিন্ন উদ্দেশ্য পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। অতি-উৎসাহকে সবসময়ই ভিন্ন চোখে দেখা হয়, এখানেও তাই। আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি খন্দকার মোশতাকের অতি-দরদেরও কথা শুনেছিলাম।

আজ যেখানে খালেদা জিয়ার প্রতি অতিরিক্ত দরদ দেখানো হচ্ছে, সেখানে এই অতিরিক্ত দরদের আড়ালে যে ভিন্ন কিছু নেই—সে কে বলবে! দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির কিছু নেতা এখানে সহচর হয়েছেন। আখতারুজ্জামানের অভিযোগ—হাসপাতালে নেওয়ার চব্বিশ ঘণ্টা বেগম খালেদা জিয়াকে কোনোপ্রকার চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। তিনি বলছেন, সশস্ত্র বাহিনী দিবসে অগ্রহায়ণের শীতে খালেদা জিয়াকে নিয়ে গিয়ে তাকে ঠান্ডা লাগানো হয়েছে, ফলে এই অবস্থা হয়েছে তার। তার অভিযোগ এখানে বিএনপির শীর্ষ নেতারাও জড়িত। স্থায়ী কমিটির নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এই দ্বন্দ্ব। তারেক রহমান যখন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার আগে দেশে স্থায়ীভাবে ফেরা কঠিন, তখন তার মন্তব্যকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার এভারকেয়ার হাসপাতালের পাশে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান মহড়া করবে। এটা নিয়ে কেউ যেন আতঙ্কিত না হয়, এ পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। ভাবুন তো, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যেখানে খালেদা জিয়া, সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এই প্রশিক্ষণ বিমানের শব্দে কি সমস্যা হবে না খালেদা জিয়ার? এটা নিয়েও বিএনপি নেতারা চুপ। এখানে এই বিমানগুলো যদি খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে নিয়ে আসার কথা বলো হতো, তবে এখানে সমস্যা ছিল না; কেউ আপত্তিও জানাত না। কিন্তু এটা প্রশিক্ষণের জন্যে। প্রশিক্ষণের নাম করে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বলা হতো তবে কে এখানে আপত্তি করত? কেউ না। লোকসমাগম ও ভিড় ঠেকাতে যদি প্রশিক্ষণের নাম নেওয়া হয়, তবে এটা যে ছলচাতুরী ও মিথ্যাচার; এটা কেন করা হলো? এই ভিড় নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা কি নেই সরকারের?
বিএনপির এক শ্রেণির নেতা বলতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের আমলে খালেদা জিয়া সুচিকিৎসা পাননি। এটা শাসকের প্রেসক্রিপশন। এই প্রেসক্রিপশন বাতলে দেওয়া হয়েছে মূলত গত ১৭ মাসের চিকিৎসায় অবহেলার দায় ঢাকতে। গত ১৭ মাসে কী চিকিৎসা করেছেন তারা খালেদা জিয়ার? একবার বিদেশ নিয়ে গেছেন। একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। এরবাইরে জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারা সশস্ত্র বাহিনীর অনুষ্ঠানে নিয়ে গেছেন, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অবজারভেশনে রেখেছেন চব্বিশ ঘণ্টা বিনাচিকিৎসায়। বলতে পারেন—অবজারভেশনও চিকিৎসার অংশ, কিন্তু একজন মুমূর্ষু রোগীর জন্যে কতটা প্রযোজ্য সেটা কি ভাবার মতো নয়? এটা কি অদ্যকার অবস্থার জন্যে দায়ী নয়?
খালেদা জিয়ার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন, অথচ বিদেশ নিয়ে যেতে বিলম্ব করা হচ্ছে। তাকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে গিয়ে হয়তো একটা সময়ে বিদেশে নেওয়াও হতে পারে; এটা যদি হয় তবে আগে কেন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না? এই বিদেশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত কি অন্তিম সিদ্ধান্ত দেশের বাইরে থেকে আসলে সরকারের দায়মুক্তি বিষয়ক?
২১ নভেম্বর খালেদা জিয়ার সঙ্গে পাশাপাশি চেয়ারে বসে হাসিমুখে ছবি তুললেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এর দুইদিন পর ওই ছবি তোলার অনুষ্ঠানে যাওয়ার কারণে ঠান্ডা লেগে হাসপাতালে গেলেন খালেদা জিয়া। সেই খালেদা জিয়াকে হুট করে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করে বসল সরকার। অথচ হাসপাতালে যাওয়ার প্রথম ১০ দিন একবারের জন্যে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ না করলেন প্রধান উপদেষ্টা। ফেসবুকে সুস্থতা কামনায় স্ট্যাটাস দিয়েছেন সত্য, আর দেখতে গেলেন ১০ দিন পর। এটা কি লোকদেখানো নয়? এই ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণাকে বিএনপির নেতারা উদযাপন করল হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে রেখে। তারা ভুলে গেল সময় এখন সরকারি ঘোষণার উদযাপন নয়, এ সময়টা স্রেফ সঠিক চিকিৎসার। বিএনপিকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে আসতে যে খালেদা জিয়া সারাজীবন ব্যয় করলেন, তার প্রতি এমন গুরুত্বহীন অনভিপ্রেত।
আজ দেশ রূপান্তর অনলাইনে একটা খবর বেরিয়েছে, খালেদা জিয়ার জন্যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে পাঠাত প্রস্তুত কাতার। ২৯ নভেম্বর এ অনুরোধ জানিয়েছে দেশটিকে চিঠি লিখেছিলেন বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম। এখানেও সরকারের অংশগ্রহণ নেই, যা করছে সেটা করছে কেবল দলই। অথচ লোকদেখানো ভিভিআইপি ঘোষণা করে বসে আছে সরকার। এখানে বিদেশে পাঠানো এবং এর দায়িত্ব নেওয়া কিছুই ছিল না সরকারের। তারা কেবল মুখরক্ষার একটা ঘোষণা দিয়ে বসে আছে, অথচ সবখানে রয়েছে তাদের চূড়ান্ত রকমের অবহেলা।
সরকারের সবরকমের অবহেলা সত্ত্বেও বিএনপির শীর্ষ নেতারা এ বিষয়কে সামনে আনতে নারাজ। তারা বরং খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার চাইতে সরকারের একটা ঘোষণার মাহাত্ম্য বর্ণনায় উচ্চকণ্ঠ। এটা খালেদা জিয়ার জন্যে দুর্ভাগ্যজনক। যে দলটির নেতারা খালেদা জিয়ার কারণেই আজকের এই অবস্থানে, দলের নেত্রীর এই কঠিন সময়ে তারা সমূহ অবহেলাকে অগ্রাহ্য করে সরকার-তোষণে ব্যস্ত সময় পার করছেন; একই সঙ্গে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে মরিয়া।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের ‘অধ্যাপক’ যোগ্যতা নিয়ে আখতারুজ্জামান রঞ্জন বলেছেন—এটা বিএনপির ‘কোটায়’। এটা নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করব না। আখতারুজ্জামান আরও বলছেন, গত সরকারের আমলে একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গড়েছেন ডা. জাহিদ গড়েছেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার দেখভালের দায়িত্ব এখানে দলীয় পদ ভার দিয়ে হয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, এখানে শুরু থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণ নেওয়া উচিত ছিল। আখতারুজ্জামান বিএনপি থেকে বহিস্কৃত বলে অনেকেই তার কথাগুলোকে আমলে নিতে চাইবেন না, কিন্তু তিনি ভুল কি বলেছেন? এখন চীন ও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বিএনপির নেত্রীর চিকিৎসা করছেন, তারা হয়তো বিদেশে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তও দেবেন; যদি দিয়ে থাকেন, তবে এটা কি দেরি হয়ে গেল না? এখানে কি সত্যি কোন ষড়যন্ত্র নেই? এখানে কি বিএনপির কেউ জড়িত নয়?

‘মাইনাস-টু’ নামে একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছিল এক-এগারো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। চব্বিশের জুলাই-সরকার দিয়ে তার শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হলো তবে? শেখ হাসিনাকে বিচারের নামে ‘মাইনাস’ সম্পন্ন, বাকি খালেদা জিয়া, তাকে কি চিকিৎসার মাধ্যমে কিংবা বিনাচিকিৎসায়? দেশ থেকে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির নির্মূল করা হবে বলে এতদিন বলছিল যারা, তারা কি এর মাধ্যমে সফল হতে যাচ্ছে?
হাসিনা নাই, খালেদা নাই; জয় নাই, তারেক নাই, পুতুল নাই—এই নাই-নাইদের ভিড়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ থাকলেও এটা আসলে নাই-ই। ফলে দক্ষিণপন্থার যে উল্লম্ফন দেখেছিলাম আমরা, তাদের হাতে কি দেশের ক্ষমতা তুলের দেওয়ার আয়োজন সারা?
প্রবল সুবিধাজনক রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে বিএনপির যারা এতদিন আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মব ও আইন-আদালতের নামে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়ায় হাততালি দিচ্ছিলেন, তারা কি এখন নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করতে পারছেন? কামনা করি ‘মিরাকল’ কিছু ঘটুক, খালেদা জিয়া সুস্থ হয়ে উঠুন; তবে কামনা আর প্রার্থনা থেকে বাস্তবতা অনেক দূর। এই সময়ে সত্যি যদি তারেক রহমান না ফিরতে পারেন তবে কেবল বিএনপির রাজনীতিরই সর্বনাশ হবে না; সর্বনাশ হয়ে যাবে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিরও।
আপনি তারেক রহমানের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আদর্শের প্রবল বিরোধী হলেও এই মুহূর্তে অন্তত তার দেশে ফেরাকে স্বাগত জানান। তারেক রহমান কেবল বিএনপিরই ত্রাণকর্তা হবেন না, এই মুহূর্তে তিনিই একমাত্র পারেন বাংলাদেশকে রক্ষা করতে। আমরা ধ্বংসের মুখোমুখি, দেশ বাঁচাতে এই মুহূর্তে তারেক রহমানের ফেরা ছাড়া উপায় নাই। তিনি যোগ্য নাকি অযোগ্য—এই হিসাব পরে হবে; আগে দেশ!




