কাবিনে সই করে সংসার না করেও বেরিয়ে যেতে পারে বিএনপি

জুলাই সনদ নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি বলছে—‘জুলাই সনদে সইয়ের সময় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল, পরে মুদ্রিত পুস্তকে এর কয়েকটি দফায় অগোচরে বদল করা হয়েছে। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন জুলাই সনদের চূড়ান্ত কপি কারও সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। পরে ছাপানো পুস্তকের কপিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মত কয়েকটি দফা আমাদের অগোচরে ফের সংশোধন করা হয়’।

বিএনপির এই দাবিকে সত্য বলে ধরে নিলে এটা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘প্রতারণা’। এখানে প্রতারণা আমার মন্তব্য যদিও, তবে এটা বিএনপির বক্তব্য থেকেই নেওয়া। তারা এখন বলছে, ‘জুলাই সনদ দিয়ে জনগণের সঙ্গে ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে’।

এখানে প্রতারিত হিসেবে বিএনপি নিজেদের ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে। কিন্তু সত্যি কি তারা ভিক্টিম?

বিএনপি যত যা-ই দাবি করুক এমনই তো হওয়ার ছিল। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের দিন বিএনপিসহ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত দলগুলো যেখানে স্বাক্ষর করেছিল ওটা ছিল একটা কাগজ। একতরফা একটা অঙ্গীকারনামা। প্রতিপালনের দাসখত দেওয়া। তারা কোন চুক্তি করেনি। পৃথক কাগজে যার যার টেবিলে বসে একটা কাগজে সই করে দিয়ে জমা দিয়েছে সরকারের গঠন করা একটা কমিশনের কাছে, এরপর সবাই একক-যৌথ এবং গ্রুপ ছবি তুলেছে। এতটুকুই!

যে অঙ্গীকারনামায় তারা সই করেছে, সেটা কোনোভাবেই কোন চুক্তি নয়। চুক্তি হলে একটা জায়গায় সকল পক্ষের স্বাক্ষর থাকত, এবং স্বাক্ষর করা পক্ষগুলো স্বাক্ষরিত কপিও পেত। কিন্তু ওখানে তারা একটা কাগজে সই করে এসেছে কেবল। কীসে সই করেছে, সেটা তাদের শোনানো হলেও দেখানো হয়নি, দেওয়াও হয়নি। ফলে ওটা ছিল অন্ধকারে ঢিল তুল্য।

‘দায়িত্বশীল’ কেউ যেকোনো কাগজে সই করার আগে সেটা দেখে। এবং সই করা কাগজ এবং একমত হওয়া বিষয়ের ওপর এরপর যাতে ছুরি না চালানো যায়, সেটা নিশ্চিত করে। এ অনুশীলনের জন্যে বিশাল যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ হতে হয় না। একবার সই করা মানে সই করা বিষয় প্রতিপালনের অঙ্গীকার। আর এটা ছিল অঙ্গীকারনামা, এবং রাষ্ট্রীয় তরফে করা; সেক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত বিষয় প্রতিপালন একদিকে যেমন নৈতিক, অন্যদিকে বাধ্যবাধকতার।

বিএনপি জুলাই সনদের মূল কপি না দেখে সই করে ফেলেছে। এখন মূল কপি দেখে তারা প্রতারিত বোধ করছে, ভিক্টিম সাজতে চাইছে। কিন্তু এটা অনুচিত। সই করার আগে এখানে তারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারত। এটা পারেনি। এটা তাদের একদিকে যেমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অন্যদিকে অযোগ্যতা। প্রশ্ন কি তোলা যায়— এমন অযোগ্য নেতা ও নেতৃত্বকে কীভাবে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করল বিএনপি? না, এমন প্রশ্ন করছি না, কারণ তারা বড় নেতা, এবং বড় নেতাদের প্রতি আমি ক্ষুদ্রের বেয়াদবিও হয়ে যেতে পারে। তাই স্রেফ শিষ্টাচারের স্বার্থে আমার পক্ষ থেকে এই প্রশ্ন তুললাম না। কিন্তু সত্যি কি এই প্রশ্ন কেউ করছে না, করবে না?

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সালাহউদ্দিন আহমেদ বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় সই করেছিলেন। নামের ভারে, মুখের কথায় তাদেরকে যতখানি দায়িত্বশীল ভাবতাম আমরা, কিন্তু মূল দলিল না দেখে একটা কাগজে সই করে আসায়, আমাদের পূর্বের ভাবনায় ধাক্কা খেয়েছে। তাদের দৈন্য, রাজনৈতিক জ্ঞানের গরিবি কি রূপ ফুটে ওঠেনি? অথচ এই দলটি আগামীতে সরকার গঠনের সবচেয়ে বড় দাবিদার।

যে দল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের বড় দুই নেতার এমন দৈন্যে কি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে দেখা যাচ্ছে? আমি রীতিমত আঁতকে ওঠছি। এরা নিজ দেশে রাষ্ট্রীয় একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে এভাবে ‘প্রতারিত’ হলে, দেশের বাইরে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বড় পরিসরে কী করবে? পরে কি বলতেও পারে—এমন হবে আমরা বুঝিনি!

মর্নিং শোজ দ্য ডে—বলে যে কথা আছে। ফখরুল ও সালাহউদ্দিনের অঙ্গীকারনামায় সই তার প্রমাণ। দেশবাসী প্রস্তুত থাকো—এমন শাসক আসতে যাচ্ছে, যারা কোথায়-কী বিষয়ে অঙ্গীকার করে সেটা জানে না। এরপর আবার লোকলজ্জার মাথা খেয়ে বড়গলায় খেলে ভিক্টিম কার্ড। নিজেদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতা ডাকতে যেখানে তাদের চুপ থাকার কথা, সেখানে তারা উচ্চকিত।

ফখরুল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন আহমদ বিএনপির বড় দু’নেতাই কেবল নয়, তারা বিএনপি সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। অনেকেই বিএনপির শাসনামল দেখেনি, অনেকেই ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছে। কিন্তু আমরা যারা দেখেছি তারা জানি, একটা ভয়াবহ দুঃশাসনের কাল ছিল বিএনপি-জামায়াতের যৌথ শাসনামল। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, লুটপাটের মহোৎসব ছিল সে সময়। ঘরে-রাস্তাঘাটে যেমন মানুষ নিরাপদ ছিল না, তেমনি নিরাপদ ছিল না শিক্ষাঙ্গন। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে শিক্ষাঙ্গনে প্রায়ই পড়ত লাশ। বিদ্যুৎ ছিল না, ছিল কেবল বিদ্যুতের খাম্বা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কিছুই ছিল না। গ্যাস-পানির জন্যে বিএনপির এমপিকে দৌড়ানি দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল রাজধানী ঢাকায়। সার-বিদ্যুতের দাবিতে গুলি খাওয়ার ঘটনাও ছিল। ছিল অপারেশন ক্লিনহার্ট, ক্রসফায়ারের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। অনেকেই স্লোগান দি তখন—‘ক্ষুধার জ্বালায় পেটে বিষ, আর নয় ধানের শীষ’! ওটা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্লোগান ছিল, তাই আমি এটাকে এনডোর্স করতে যাছি না।

এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধুসন্তু সাজা বিএনপির নেতাদের দেখে যেখানে কিছুটা আশাবাদী হতে যাচ্ছিল মানুষ, সেখানে বড় ধাক্কা হয়ে এল দলিল না দেখে কাগজে সই করার মতো ঘটনা। এখন তাই এনসিপির মতো কিংস পার্টিও তাদের নিয়ে মশকরা করছে। দলটির নেতারা নিজেরা জুলাই সনদে সই না করলেও এই সনদের পক্ষ নিয়ে বিএনপির দিকে তীর ছুঁড়ে বলছে—কাবিনে সই করেছ, এখন সংসার তোমাদের করতেই হবে।

বিএনপিকে নিয়ে এনসিপির এই পরিহাস, এই কৌতুক যদিও চটুল, তবু এটা অসত্য নয়। যারা কাগজে সইয়ের আগে সামান্য দায়িত্বশীল হতে পারে না, তাদের জন্যে এটাই তো নিয়তি।

তবু বিএনপির সামনে সুযোগ আছে এখান থেকে বেরিয়ে আসার। তারা চুপ হয়ে যেতে পারে এখানে। চুপ থেকে এরপর নির্বাচনের পর যখন সরকার গঠন করবে, তখন এক ধাক্কায় এই সনদের কিছু বিষয়কে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারে। ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ যতই বলুক না কেন—সংসদ ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই সনদ পাস না করলে, এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদে প্রতিস্থাপন হয়ে যাবে। এটা জবরদস্তিমূলক সুপারিশ, এবং এই সুপারিশের আইনগত কোন ভিত্তি নেই। এটা রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে, অথবা উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও এখন আইনি ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা করলেও, এটা টিকবে না। কারণ বর্তমানের সবকিছুরই বৈধতা দেওয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার আগামী সংসদের। কেবল তাই নয়, এইধরনের সুপারিশ, এমনকি জুলাই সনদের অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করার প্রত্যেকে সংবিধান লঙ্ঘনে বিচারের মুখে পড়বেন কিনা—সেটাও নির্ধারণ করবে আগামীর সরকার। এখানে বিএনপি এই মুহূর্তে কোণঠাসা হয়ে থাকলেও, দাওয়াই কিন্তু তাদের হাতে।

ফখরুল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন আহমদ জুলাই সনদ না দেখে অঙ্গীকারনামায় সই করে এসে যে ভুল করেছেন, এটা সংশোধনের সুযোগ থাকছে বিএনপির সামনে। এজন্যে তাদের অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচন পর্যন্ত। এদিকে, এখন যে পরিস্থিতির জন্ম দেওয়া হচ্ছে, সেটা নির্বাচনকে দূরে ঠেলার ভয়ঙ্কর রকমের অভিসন্ধি। বিএনপি এখানে জুলাই সনদ, গণভোট, পিআর নিয়ে চুপ করে থেকে নির্বাচন আদায় করে নিয়ে, পরে পুরো প্রক্রিয়াকে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারে। তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারবে না ঠিক, কারণ সরকার অবৈধ ঘোষিত হলে নির্বাচনই অবৈধ হয়ে যাবে; তবে পারবে নির্বাচন বাদে বাকি সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতে।

বিএনপিকে বলি—ভিক্টিম সাজিও না, ভিক্টিম সাজতে গেলে দৈন্য প্রকাশিত হয়ে যাবে। সংবাদ সম্মেলনে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছ—এতটুকুই যথেষ্ট। এখন উচিত হবে নির্বাচন আদায় করে নেওয়া। একবার নির্বাচন হয়ে গেলে নাটাই চলে আসবে হাতে। তখন তোমাদের সামনে সুযোগ থাকবে যে সব বিষয়ে ঐক্য হয়েছে, কেবল সেসব বিষয়েই বাস্তবায়ন।

Tags :

Kabir Aahmed

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025