এবারের জুলাইয়ের প্রথম প্রহরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সম্মানিত অধ্যাপকের (সংগত কারণে নামোল্লেখ করছি না) একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসে চোখে আটকে গেল। তিনি লিখেছেন: “আজ ৩৬৬ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।” তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক-পেশাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান শ্রদ্ধা করার মতো; আমি করিও।
ফেসবুকে তাঁর সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন ধরে আছি। সম্মানের চোখে তাঁর প্রতিটি লেখা পড়ে থাকি। অনেক বিষয়ে আমার ব্যক্তিক মতামত তাঁর সঙ্গে মেলে না, তবু বলি না বেশিরভাগ সময়। এই না বলা মানে সমর্থন করা নয়; আবার বিরোধিতা মানে অস্বীকার নয়।
ফেসবুক কমেন্টের দ্বিমতে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে থাকে। আমি জানি না, তিনি নেন কিনা। তবে আমি নিই না। আমার কোন লেখায় তিনি কোন কথা কখনো বলেছেন কিনা মনে পড়ছে না। হয়ত বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। তবে আমি যখনই কিছু বলেছি তাঁকে, সে সময় খেয়াল রেখেছি যাতে ব্যক্তিক আক্রমণ না প্রকাশ হয়। পাশাপাশি খেয়ালও রেখেছি আমার কোন শুভানুধ্যায়ী আমার কোন মন্তব্যের সূত্র ধরে যেন এমন কিছু না করে, যাতে তিনি অসম্মানিত হোন!
নাতিদীর্ঘ এই ভূমিকার অবতারণা মূলত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ কেন্দ্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত শিক্ষক যখন ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে ‘৩৬৬ জুলাই; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ লেখেন, তখন এটা কেবল ব্যাকরণগত ত্রুটিই নয়, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসকে বিকৃত করার নামান্তর। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কেউ নই বলে হয়ত এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ নিতে পারছি না। ইতিহাস বিকৃতিকে গ্রহণ করতে পারছি না। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের ধারণাটি কেবলই ওই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নয়, এটা জাতীয় পর্যায়ের আলোচ্যও। এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় নাগরিক হিসেবে আমাদেরও অপ্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের একজন দায়িত্বশীল হিসেবে তাঁর কাছ থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আরও দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করি। তিনি গতবছরের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষক সমাজের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এই ভূমিকার কারণে তিনি জুলাইয়ের আন্দোলনের প্রতি সহমর্মি হওয়া অপ্রত্যাশিত নয়, কিন্তু অপ্রত্যাশিত হচ্ছে আন্দোলনের ভূমিকা দিয়ে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে গুলিয়ে ফেলেন।
ভূমিকা শেষে এবার ফিরছি মূল প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গ সে একই; ‘জুলাই’! প্রথমবারের মতো ‘জুলাই’ উদযাপন এবার ঘটা করে হচ্ছে। সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যম, কেউ বাদ নেই। একদল লোক জুলাই আন্দোলনের চেতনা থেকে, আরেকদল লোক অনুকম্পাপ্রত্যাশায় এই জুলাই উদযাপন করতে শুরু করেছে। এবার প্রথমবারের মতো দেশে জুলাইকে ‘মহিমান্বিত মাস’ হিসেবে উদযাপন শুরু হয়েছে। ধারণা করছি এটা যেমন প্রথমবারের মতো, পাশাপাশি সন্দেহও প্রকাশ করছি এবারের মতো আর কখনো হবে কিনা! কারণ পরেরবার ‘জুলাইয়ের কেউ’ সরকারে থাকবে না। নির্বাচন যদি হয়, তবে আসবে নতুন সরকার, না হলে রাজনীতির মাঠ থাকবে উত্তপ্ত। তাই পরের জুলাই হবে অনেকটাই ‘নিরামিষ’।
অতি-আবেগে হয়ত অনেকে ‘নিরামিষ’ শব্দে আপত্তি জানাতে পারেন, তবে এটা পূর্বানুমান আমার, এবং এর সঙ্গে আছে বাস্তবতা ও যুক্তির মিশেল।
ইতিহাস জুলাইকে লিখে রাখবে স্রেফ কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলন থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে মোড় নেওয়া এক আন্দোলন হিসেবে। ২০২৪ সালে কোটা ব্যবস্থা বিলোপ করে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের দাবিতে একটা আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল। একটা সময়ে এই আন্দোলন জুলাই শেষে আগস্টের শুরুতে গিয়ে পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এবং এরপর একদিনের একটা ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়ে যায়। সেই আন্দোলন সফল হয়ে যাওয়ার পর, আন্দোলনকারীরা বড় অংশ এটাকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ আখ্যা দিয়ে একাত্তরের সমান্তরালে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা শুরু করে। তবে একাত্তরে প্রশ্নে আপোষহীন দেশের অধিকাংশ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রতিবাদে সেটা নস্যাৎ হয়ে গেছে।
চব্বিশের আগস্টের যে সরকার ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেছিল, তারা নানাভাবে চেষ্টা করেছে আগস্টে পাওয়া তাদের বিজয়কে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড় করাতে। তারা সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে। তবু পারছে না।
মুহাম্মদ ইউনূসের ইন্টেরিম শাসনে দেশে ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি ও মার্চ গেছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় তরফে ঐতিহাসিক ও মহাকাব্যিক মাস আর দিবসগুলোর উদযাপন ছিল একবারের সাদামাটা। কিন্তু জুলাই নিয়ে আগ্রহ ও উদযাপনের শেষ নাই। তারা জুলাই-আগস্টকে মহিমান্বিত করার মানসে একাধিক দিবসের ঘোষণা দিয়েছে, মাসাধিক কালের নিয়েছে কর্মসূচি এবং ব্যয় করছে রাষ্ট্রীয় অর্থ ও ক্ষমতা। বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম ও জন্মযুদ্ধ কেন্দ্রিক দিবসগুলোকে প্রায় অগ্রাহ্য করলেও জুলাই-আগস্টকে কেন্দ্র করে তাদের আগ্রহের শেষ নেই। তারা এ-দুই মাসকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে নেমেছে, তাতে আদতে নাগরিক প্রতিক্রিয়া মোটেও ইতিবাচক নয়। সরকারি ও অনুকম্পাপ্রত্যাশী বেসরকারি কর্মসূচিগুলো হয়ে পড়েছে আলগা, এবং অনেকটাই ফরমায়েশি। ঐতিহাসিক মাস ও দিবসগুলোকে উপেক্ষা করে একটা রাজনৈতিক আন্দোলনকে মুখ্য ইতিহাস হিসেবে প্রতিস্থাপনের ‘অপচেষ্টা’ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ভীষণভাবে পীড়িত করেছে। বিভ্রান্তির বেড়াজালে এতগুলো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জড়িয়ে পড়ার দৃশ্য আহত করেছে। তবু স্বস্তি খুঁজেছি এটাকে ‘সাময়িক ভ্রান্তি’ বিবেচনা করে!
এই যে ‘জুলাই’ এর ইতিহাস ও বিশ্লেষণ সর্বজনীন নয়। একদলের এটা ‘উৎকৃষ্ট জুলাই’, আর আরেক দলের কাছে এটা ‘নিকৃষ্ট জুলাই’। দু-পক্ষেরই যুক্তি আছে। একদল এটাকে ‘মুক্তি’ বলছে, ‘বিপ্লব’ বলছে; আরেক দল এটাকে বলছে ‘প্রতারণা’ ও ‘ষড়যন্ত্র’। একদল এটাকে ‘ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান’ বলছে; আরেক দল বলছে ‘ফ্যাসিজমের শুরু’। কারো যুক্তিই যেখানে ফেলনা নয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের নিতে হবে অনাগত ভবিষ্যৎ ও ইতিহাসের কাছে আশ্রয়। ইতিহাসই নির্ধারণ করবে — জুলাই আদতে কী; মুক্তি নাকি ষড়যন্ত্র! বছর দিন শেষে যখন প্রাথমিক উত্তর খুঁজতে যাচ্ছি, তখন ইতিবাচক কিছু খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন!
জুলাই নিয়ে এত আলোচনা, এতে দেখা যায় এ-জুলাই দিয়ে সবচেয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পুলিশ। আন্দোলনের সময়ে তারা আগ্রাসী যেমন হয়েছে, তেমনি তারা আক্রান্ত হয়েছে। তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তারা মানুষ মেরেছে, মানুষ তাদের মেরেছে। এরপর যেখানে তারা ন্যায়বিচারের মুখে পড়ার কথা ছিল, সেখানে তারা সমানাধিকার পায়নি। সরকারের আগ্রাসী ও একপাক্ষিক অবস্থানের কারণে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম অধিকার ভোগের অধিকার হারিয়েছে। তাদেরকে বিনাশ করা ‘বীরত্বের সূচক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রতি এমন অন্যায় অমানবিকই কেবল নয়, এটা বৈষম্য এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধারার একটা সূচনা হয়েছে। সরকারি সহায়তায় গড়ে ওঠেছে একটার পর একটা রাজনৈতিক দল। যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পুরো আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে, তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতাদের নেতৃত্বে গড়েছে ওঠে একটা দল। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এ-রাজনৈতিক দলটির নাম ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি’, সংক্ষেপে ‘এনসিপি’। এরা সরাসরি সরকারে না থাকলেও সরকারি দল, এবং তাদের চিন্তাচেতনা ও অপ্রত্যক্ষ নির্দেশনায় পরিচালিত হচ্ছে সরকার। তাদের কর্মসূচিগুলো হচ্ছে সরকারের কর্মসূচি। তারা রাজনৈতিক দল রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ফেব্রুয়ারির শেষ দিনে। কিন্তু এই ক’মাসে তারা উল্লেখযোগ্য রকমের সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
কিংস পার্টি এনসিপির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। তারা এরইমধ্যে আর্থিক ক্ষেত্রে লাভবান হয়েছে। রাজনীতির মাঠে তারা আদৌ টিকতে পারবে কিনা এটা নিয়ে ঘোর সন্দেহ।
তাদের বাইরে জুলাই আন্দোলনের প্রকৃত বেনিফিসিয়ারি মূলত বিএনপি। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠের আন্দোলনে ব্যর্থ হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হওয়ার পর তারাই আগামীর সরকার গঠনের জোর দাবিদার। দেশব্যাপী তাদের বিপুল জনসমর্থন রয়েছে সত্য, কিন্তু আন্দোলনের মাঠে তারা ব্যর্থ হলেও ইন্টেরিম সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে দলবদল নিয়ে লন্ডনে যেতে হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করতে। বৈঠকে নির্ধারিত হয়েছে নির্বাচনের প্রাথমিক তারিখ। জুলাইয়ের মূল বেনিফিসিয়ারি মূলত এ-বিএনপিই। তাদের লাভবান হওয়ার অন্য অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। তন্মধ্যে রয়েছে— তাদের সকল নেতার মামলা থেকে অব্যাহতি, রায় থেকে খালাস পাওয়া, একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার রায় থেকে খালাস, দশ ট্রাক অস্ত্রের যে নজিরবিহীন ঘটনা সেটা থেকেও খালাস, সীমাহীন দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য ও নাজুক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে জনরোষ, জঙ্গিবাদের উত্থানসহ সকল ব্যর্থতা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে গেছে। এখন তারা অনেকটাই দুধে ধোয়া তুলসিপাতা রূপ। জুলাইয়ের আন্দোলনের ফলে নতুন বন্দোবস্তের দেশে তারা সারাদেশে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, দখল বাণিজ্য, মামলা বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
বিএনপির বাইরে জামায়াতে ইসলামী, ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য ছোটখাট দলগুলোও বেনিফিসিয়ারি। অস্তিত্ব বিলীনের পথে তারা পেয়েছে লাইফলাইন। এখন তারা আগের চাইতে বেশি শক্তিশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন ফিরে পেয়েছে, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী এটিএম আজহারুল ইসলাম নজিরবিহীনভাবে ফাঁসির দণ্ড থেকে সরাসরি খালাস পেয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের নামে রাজনীতি করা জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা নিজেদের পরিচয়ে এখন রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সরকারের সরাসরি অংশ না হয়েও সরকারে রাখছে তারা নীতিনির্ধারণী ভূমিকা।
দীর্ঘদিন ধরে বিপুল বিক্রমে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা আওয়ামী লীগ বিপন্ন হয়েছে জুলাইয়ের আন্দোলনে। নির্বাহী আদেশে দলটির কার্যক্রম দেশে নিষিদ্ধ। তারা ফিরতে পারছে না। নেতৃত্বের সংকট, নেতাদের প্রতি আস্থাহীনতা প্রকট রূপে প্রকাশিত। ফিরে আসা আর সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও নয়া বাস্তবতায় তারা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কী করতে পারে, সেটাই দেখার।
জুলাইয়ে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য প্রকাশ করে দিয়েছে। অথচ এই সেক্টরে এতদিন আওয়ামী লীগ ছিল সমৃদ্ধ। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন যাদের পুষেছিল তারা কাজে লাগেনি। জুলাই-পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে ‘ন্যারেটিভ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটা তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সরকারের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে মুছে দিয়েছে। এক বছরে এই সেক্টরে তারা দৃষ্টি দিতে পারেনি।
জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক উলটপালট ঘটলেও এটা নিয়ে যে ‘আদিখ্যেতা’ চলছে এটা অনেকটাই বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। দেশে বিভিন্ন সময়ে অনেক সরকারের পতন ঘটেছে অনেক আন্দোলনে, কিন্তু এবারের মতো এত বড় করে বিষয়টা দেখা হয়নি। এই না দেখার পেছনে যুক্তি ছিল, কিন্তু এখন যা চলছে সেটা চলছে যুক্তিহীন চর্চা। এই যুক্তিহীন চর্চায় ব্যক্তিগতভাবে আমি একমত নই। আমার কাছে—জুলাই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সপ্তম মাসই কেবল!
‘জুলাই চেতনা’ আওয়াজ দেয় যারা, তারা ভুল পথে পরিচালিত। জুলাইয়ের আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটার বৈষম্য বিলোপের ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু সেই আন্দোলনের পথ ধরে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীন দেশ, সেখানে কোটা ব্যবস্থার পুনর্বহাল হয়েছে। আগে ছিল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে কোটা, কিন্তু এখন কোটাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে সর্বগ্রাসী রূপে। এটা প্রকৃতই জুলাই চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বেইনসাফি। মূল চেতনা হারানো জুলাইকে প্রতিষ্ঠা করা তাই জুলাইয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আপনারা যদি কোনকিছু প্রতিষ্ঠা করতে চান, তবে সৎ থেকে সেটা করার চেষ্টাই করুন। অদ্যকার এই উদযাপনে ব্যাপক আয়োজন থাকলেও জুলাইয়ের আন্দোলন সূচনার মূল সুর অনুপস্থিত। এটা তাই দীর্ঘস্থায়িত্ব পাবে না।
যারা ‘উৎকৃষ্ট জুলাই’, আর যারা ‘নিকৃষ্ট জুলাই’ বলছে, তাদের প্রত্যেকের এই চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করি। স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রশ্নে অন্যদের থেকেও একই প্রত্যাশা নিশ্চয় বাড়াবাড়ি নয়!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।