জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে সহায়তা পাচ্ছেন না আহতরা

জুলাই আন্দোলনের প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হলেও ওই আন্দোলনে আহতদের সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। আহতদের অনেকেই জুলাই ফাউন্ডেশনে বারবার আবেদন করেও পাচ্ছেন না সহায়তা। দীর্ঘসূত্রতা, অর্থ সংকট এবং প্রশাসনিক ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও নিহত পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে গঠিত হয় ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’। ফাউন্ডেশনটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অনেক ‘জুলাই যোদ্ধা’। তবে এতদিনেও তালিকাভুক্ত আহতদের মধ্যে অর্ধেকেরও কমসংখ্যক সহায়তা পেয়েছেন।

ফাউন্ডেশন কার্যালয় শাহবাগে গিয়ে সহায়তার জন্য ঘুরেও অনেক আহত ব্যক্তি সহায়তা পাননি—এমন অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা, সহায়তা ও পুনর্বাসন সরকারের অগ্রাধিকার কর্মসূচি হলেও প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ সংকটে কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

এ সহায়তা কার্যক্রম শেষ করতে প্রয়োজন প্রায় ২৩১ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দ। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে ফাউন্ডেশন। পাশাপাশি, সমাজের বিত্তবানদেরও আহতদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

এদিকে, আহতদের সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘বিশেষ কর্মসূচি দগ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা’ সংশোধন করেছে। এখন থেকে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরাও এ কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পাবেন।

সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী, আহত ব্যক্তিরা এককালীন ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পাবেন। পাশাপাশি, তারা কম সুদের ৫০ হাজার টাকার ক্ষুদ্রঋণও নিতে পারবেন।

তবে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা কিছু পরিবার অভিযোগ করেছে, এক মাসের বেশি সময় ধরে আবেদন করে কোনো সাড়া পাননি। বারবার অফিসে গিয়েও শুধু আশ্বাস পেয়েছেন। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সমস্যার সময় যদি সহায়তা না পাওয়া যায়, পরে টাকা দিয়ে আর কী হবে? চিকিৎসার পাশাপাশি মানসম্মত খাবার ও সংসার চালাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তারা অভিযোগ করেন, যাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, এখন তাদের কাছে গেলে দেখা পাওয়া যায় না, সাড়া মেলে না।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সহায়তার জন্য নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়। ভবিষ্যতেও এ ধরনের আন্দোলন বা অন্য কোনো ঘটনায় আহত ব্যক্তিরাও এ কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পাবেন।

নিবন্ধিত চিকিৎসকের মাধ্যমে আহত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা নিরূপণ করা হবে এবং সমাজকর্মীরা তা যাচাই করবেন। যেসব ব্যক্তি এরই মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন, তারা শুধু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণ পাবেন; এককালীন অনুদান প্রাপ্য হবেন না।

এ কর্মসূচি সারা দেশে কার্যকর হবে। দগ্ধ, আহত ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যে কোনো সময় উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় বা হাসপাতালে আবেদন করতে পারবেন।

নীতিমালা অনুযায়ী, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবেন—যারা শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। এ ছাড়া বয়োজ্যেষ্ঠ, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, দরিদ্র, ভূমিহীন ও গৃহহীন ব্যক্তি, একাধিক নির্ভরশীল পরিবারের কর্তা এবং নারী আবেদনকারীরাও অগ্রাধিকার পাবেন।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ১৮৮ জন। এ পর্যন্ত ফাউন্ডেশন পেয়েছে ১১৯ কোটি টাকা। তাতে এখনো ৮ হাজার ৪৪৬ জন আহত সহায়তা পাননি। আহতদের ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’ শ্রেণিতে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করেছে।

এই শ্রেণিভুক্তদের জন্য চিকিৎসা ও মাসিক ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

আর্থিক সহায়তা পেতে আবেদনকারীর পরিবারের বার্ষিক আয় ২ লাখ টাকার কম হতে হবে। শারীরিক ও মানসিক আঘাত এবং আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় অনুদান নির্ধারণ হবে ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার মধ্যে।

নীতিমালা অনুযায়ী: এক হাতে আঘাত পেলে ১ লাখ টাকা, দুই হাতে আঘাত পেলে ২ লাখ টাকা, এক পায়ে আঘাত পেলে ১ লাখ টাকা, দুই পায়ে আঘাত পেলে ২ লাখ টাকা, চোখে আঘাতে দৃষ্টিশক্তি হারালে ২ লাখ টাকা, কানে আঘাতে শ্রবণশক্তি হারালে ২ লাখ টাকা, মাথার বাহ্যিক আঘাতে ১ লাখ, অভ্যন্তরীণ আঘাতে ২ লাখ টাকা, অন্যান্য অঙ্গে আঘাত বা মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ১ লাখ টাকা, কোনো অঙ্গ হারিয়ে স্থায়ী কর্মক্ষমতা হারালে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা। একাধিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সর্বোচ্চ অনুদান সীমা ৫ লাখ টাকাই থাকবে।

সূত্র জানায়, ২০০২ সালে সরকার দগ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য ‘অ্যাসিড দগ্ধ ও প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কার্যক্রম’ নামে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে। তখন মূলত অ্যাসিড দগ্ধ ব্যক্তিরাই সুবিধা পেতেন।

২০১০ সালে এটি প্রথম সংশোধিত হয়, পরে সর্বশেষ সংশোধন হয় ২০১৫ সালে। সে নীতিমালায় দগ্ধদের চিকিৎসা বাবদ ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হতো। ক্ষুদ্রঋণ সুবিধাও ছিল, সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা।

বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এই অনুদান ও ঋণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল আকবর বলেন, ‘এ পর্যন্ত ১১৯ কোটি টাকা পেয়েছি, যা দিয়ে সব জুলাই যোদ্ধাকে সহায়তা করা যায়নি। মোট ভিকটিম ১৫ হাজার ১৮৮ জন। এর মধ্যে এখনো টাকা পাননি ৮ হাজার ৪৪৬ জন। এই কাজ শেষ করতে প্রয়োজন প্রায় ২৩১ কোটি টাকা।’

তিনি জানান, আর্থিক সংকট কাটাতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি জুলাই যোদ্ধাদের স্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্যও ফাউন্ডেশন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

সূত্র: কালবেলা

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025