জুলাই ফাউন্ডেশনে নির্যাতনের অভিযোগ

জিজ্ঞাসাবাদের নামে ডেকে নিয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন কয়েকজন। ভুয়া তথ্য দিয়ে জুলাইযোদ্ধা হিসেবে সরকারি তালিকায় নাম দিয়েছেন এমন অভিযোগ যাচাইয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় নির্যাতন করা হয় বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

ফাউন্ডেশনের সিইও জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করলে ঘটনার তদন্ত হবে। আর এখন থেকে কাউকে ফাউন্ডেশনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। প্রয়োজন হলে এটি আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্টরা দেখবে।

ভুক্তভোগীদের একজন মো. জাহাঙ্গীর আলম। তাকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে ডেকে নেয়া হয় গত ২৭শে মে। সেখানে যাওয়ার পর তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। শাহিদ নামের এক ব্যক্তি জাহাঙ্গীরকে জিআই পাইপ দিয়ে মারধর করেন। মারধর করে তার কাছ থেকে ভুয়া আহত প্রমাণের মিথ্যা স্বীকারোক্তি নেয়ার চেষ্টা করা হয়। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের অফিসের শেষের দিকে একটি কক্ষে এই নির্যাতন চালানো হয়। এক পর্যায়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তাকে পুলিশে তুলে দেয়ার আকুতি জানান জাহাঙ্গীর। তবুও মারতে থাকে তারা। পরে একটি রাজনৈতিক দলের নারায়ণগঞ্জের একটি উপজেলা সভাপতিকে ফোনে জানালে তার অনুরোধে জাহাঙ্গীরকে ফাউন্ডেশনের পেছনের গেইট দিয়ে বের করে সিএনজিতে তুলে দেয়া হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজের ঢালে রাস্তার ওপর হামলার শিকার হন জাহাঙ্গীর। একপর্যায়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে বারাকাহ্‌ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে আমার মাথায় অপারেশন করা হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় গেলে, গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আমি সোনারগাঁও থানায় নিজে বাদী হয়ে শেখ হাসিনা ও নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখ করে মামলা করি। এসব কিছুর ডকুমেন্ট রয়েছে আমার কাছে। আমি জুলাই আন্দোলনে আহত হয়েছি, তার ভিডিও ফুটেজসহ সব কিছু আছে। আমার এমআইএস হয়েছে, আমি সরকারি গেজেটভুক্ত হয়েছি। আমার গেজেট নাম্বার ২৩০৬। কিন্তু ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ আমাকে ভুয়া প্রমাণ করতে অকথ্য নির্যাতন করে। নির্যাতনের পরে ডাক্তারের কাছে গেলে আমাকে সিটিস্ক্যান, এম.আর.আই সহ কয়েকটি পরীক্ষা করতে বলে। কিন্তু অর্থ সংকটে আমি সব পরীক্ষা ও চিকিৎসা করতে পারিনি। তিনি বলেন, আমি যদি ভুয়া আহতও হতাম তবুও তো আমার অসুস্থতা বিবেচনায় তারা এভাবে মারতে পারে না। আমি এর সঠিক বিচার চাই। আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবো।

গত বছরের ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সানারপাড় এলাকায় আহত হন বুলবুল শিকদার ও তার ছেলে রাকিবুল শিকদার। স্থানীয় একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন বুলবুল ও রাকিবুল। বুলবুলের অবস্থার অবনতি হলে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) স্থানান্তর করা হয়। বুলবুল ও তার ছেলে ইতিমধ্যে ‘এমআইএস’ভুক্ত হয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহতদের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা নিয়েছেন। কিন্তু ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের দাবি তারা ভুয়া আহত।

বুলবুল শিকদারের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, গত ২০ মার্চ প্রতারণার অভিযোগে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে ডেকে নেয়া হয় বুলবুল ও তাকে। ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ-আহত বুলবুল জুলাই আন্দোলনে গিয়ে আহত হননি। তিনি ভুয়া আহত সেজেছেন। ফাউন্ডেশনে যাওয়ার পরে আমার স্বামীকে অফিসের ভেতরে ডেকে নেয়া হয়, আমি বাইরে একটি চেয়ারে অপেক্ষা করতে থাকি। তখন ছিল রোজার মাস। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষমাণ থাকার পরও বুলবুল না ফিরলে আমি নিচে গিয়ে একটি মোবাইল দিয়ে বুলবুলের ফোনে কল দেই। আমার মোবাইলে তখন ব্যালেন্স ছিল না। বুলবুলের ফোন অন্য একজন রিসিভ করলে আমি তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করি। তিনি জানতে চান আমি কে? আমি বুলবুলের স্ত্রী পরিচয় দিলে আমাকে বলে, ‘আপনার স্বামীকে জামাই আদর করা হচ্ছে, দ্রুত জুলাই ফাউন্ডেশনের অফিসে চলে আসুন’।

তিনি বলেন, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ দিকে দু’টি রুম আছে। সেখানে সবাই যেতে পারে না। শুধু ফাউন্ডেশনের লোকজনই সেখানে যেতে পারে। আমার অসুস্থ স্বামীকে সেই রুমে নিয়ে ফাউন্ডেশনের প্রধান ভেরিফিকেশন কর্মকর্তা সাগর মারধর করতে থাকেন। তিনি ‘লাইলনের মতো একটি পাইপ’ দিয়ে তাকে আঘাত করেন। এতে বুলবুল আরও আহত হয়ে যায়। ফোনে কথা বলার পরে, আমি অফিসে গিয়ে স্বামীর খোঁজ নেই তখন অফিসের একটি রুমে আমাকে আটকে রাখা হয়। এসময় আমার চুলে ধরে নির্যাতন করে আর বলে, যে আমি যেন স্বীকার করি যে, আমার স্বামী ও ছেলে ভুয়া আহত। কিছুক্ষণ পরপর তারা আমার কাছে এসে বলে, আমার স্বামী এই কথা বলেছে আপনি কি বলেন, আবার আমার কথা বলার পরে তারা আমার স্বামীর কাছে বলে যে, আপনার স্ত্রী বলেছে যে, আপনি ভুয়া আহত সুতরাং আপনি স্বীকার করেন। এভাবেই তারা আমাদের সারা দিন ফাউন্ডেশনে আটকে নির্যাতন করে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে থাই গ্লাসের ব্যবসা করতো। কিন্তু নির্যাতনে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। বাসায় আসার পরে সে পাগলের মতো আচরণ করে। আমি তাকে পাবনায় মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করি। বর্তমানে ব্যবসাটি ছেড়ে দিয়েছে। সংসার চালাতে আমি এখন গার্মেন্টেসে চাকরি করি। আমাকে গত ২০শে জুলাই পুনরায় ফাউন্ডেশনে ডেকে নেয়া হয়। এসময় আমাকে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা প্রিন্স সতর্ক করে বলেন, আমি যেন আমার ও স্বামীর ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তা যেন কাউকে না বলি। যদি বলি তাহলে আমাদের আরও সমস্যা হবে। তিনি বলেন, আমি স্বামীর চিকিৎসা খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছি। আমি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে সরকারের কাছে বিচার জানাই।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ভেরিফিকেশন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান শাহীদ বলেন, আমরা অর্থ সহায়তা দেয়া শুরু করলে বিভিন্ন কারণে আন্দোলনের আহত ও নিহতদের পরিবারের সদস্যগণ ফাউন্ডেশনে আসতো। তখন ভুয়া আহতদের দেখলে অনেক প্রকৃত আহতরা তেড়ে আসতো, তাদের সঙ্গে ঔদ্ধত্য আচরণ করতো। সুতরাং এসব ভুয়া আহতদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই আমরা ফাউন্ডেশনের বোর্ড রুমের পেছনে যে রুমগুলো আছে সেখানে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম। সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরাও ছিল। কখনো যদি কারও সঙ্গে ঔদ্ধত্য আচরণ করা হয়ে থাকে, এটি দুঃখজনক ঘটনা। আমরা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

জাহাঙ্গীরের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটি ভিত্তিহীন অভিযোগ। আমরা ভুয়া আহত শনাক্ত করলে আমরা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় হবে।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সিইও কামাল আকবর বলেন, আমাদের জুলাই আন্দোলনই হয়েছিল গোপন কক্ষ কিংবা টর্চার সেলের বিরুদ্ধে। সুতরাং ফাউন্ডেশনে গোপন কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদের কোনো সুযোগ নাই। কথিত অভিযোগের এসব ঘটনার সময় আমি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে কোনো পদে ছিলাম না। আমি সিইও হওয়ার পরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ভুয়া আহত শনাক্ত হলে আমরা সরাসরি পুলিশের কাছে সোপর্দ করবো। এখানে তাদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। তবে কেউ নির্যাতনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জুলাই ফাউন্ডেশনে গোপন সেলের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমরা মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। অতি উৎসাহী হয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ নাই।

কথিত নির্যাতনের এতদিন পরে এসব অভিযোগের ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যদি কেউ সত্যিই ফাউন্ডেশনের কারও আচরণ দ্বারা আহত হয়ে থাকেন, তারা আমাদের কাছে আসলে আমরা অভিযোগ খতিয়ে দেখবো।

সূত্র : মানবজমিন

Tags :

News Desk

Most Discussed

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More on this topic

    People’s Agenda

Copyrights are reserved by NE News © 2025