মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের আসন্ন বাণিজ্য আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত শতাধিক কঠোর শর্তের একটি গোপন নথি ফাঁস হয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে এই ২১ পাতার দলিলটি জনসমক্ষে এসেছে, যার জেরে ওই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয় (ইউএসটিআর) কর্তৃক প্রেরিত এই নথি বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতি ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুক্তির মূল বিষয়বস্তু: ৬টি প্রধান ক্ষেত্র
“ইউএস-বাংলাদেশ অন রেসিপ্রোকাল ট্রেড (বাংলাদেশ স্পেসিফিক কমিটমেন্টস)” শিরোনামের এই দলিলটি মূলত ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে বিভক্ত:
- কর সংক্রান্ত শর্ত: শুল্ক ও কর কাঠামোতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব।
- অশুল্ক বাধা সংক্রান্ত শর্ত: বিভিন্ন খাতে আমদানিতে বিদ্যমান বাধা দূরীকরণ।
- ডিজিটাল বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত শর্ত: ডিজিটাল অর্থনীতি ও ডেটা নীতিমালায় পরিবর্তন।
- রুলস অব অরিজিন সংক্রান্ত শর্ত: পণ্যের উৎপত্তিস্থল নির্ধারণের নিয়মাবলী।
- অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত শর্ত: কৌশলগত খাত ও চীনের সাথে সম্পর্ক।
- বাণিজ্যিক শর্ত: মার্কিন পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি ও বাজার উন্মুক্তকরণ।
মার্কিন পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক শর্তাবলী
মার্কিন পণ্যের আমদানি বাড়ানোর লক্ষ্যে ছয়টি প্রধান শর্ত আরোপ করা হয়েছে:
- সামরিক সরঞ্জাম: মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম আমদানি বাড়ানো এবং চীনা সামরিক পণ্য আমদানি কমানো।
- বিমান পরিবহন: রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা দ্বারা মার্কিন বেসামরিক বিমান ও যন্ত্রাংশ আমদানি বৃদ্ধি।
- জ্বালানি খাত: মার্কিন জ্বালানি আমদানি নিশ্চিত করা ও দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি।
- খাদ্য নিরাপত্তা: সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য মার্কিন গম আমদানি বৃদ্ধি।
- সয়াবিন তেল: সামরিক ও সরকারি সংস্থার জন্য মার্কিন সয়াবিন তেল আমদানি এবং মার্কিন কোম্পানির সাথে সংরক্ষণাগার নির্মাণ।
- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: এই চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে (WTO) অবহিত করা।
জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত সম্পর্ক
অর্থনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত ছয়টি শর্ত বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে:
- শিপিং খাত: জাহাজ নির্মাণ ও শিপিংয়ে মার্কিন সমমানের নিয়ন্ত্রণ।
- চীনা প্রযুক্তি নিষিদ্ধকরণ: বন্দর ও জাহাজে চীনা LOGINK সিস্টেম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।
- মার্কিন অনুমতি: মার্কিন পণ্য রপ্তানি-পুনঃরপ্তানিতে ব্যুরো অব ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড সিকিউরিটির অনুমতি বাধ্যতামূলক।
- কাস্টমস তথ্য: মার্কিন নিয়ন্ত্রিত পণ্যের কাস্টমস তথ্য সরবরাহ।
- রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ: রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও আইন প্রয়োগে যুক্তরাষ্ট্রকে অংশীদার করা।
- সফটওয়্যার স্বচ্ছতা: জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার তৈরিতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি।
ডিজিটাল বাণিজ্য ও প্রযুক্তি খাতে বড় পরিবর্তন
প্রযুক্তি খাতে পাঁচটি প্রধান শর্ত রয়েছে:
- তথ্য বিনিময়: আন্তর্জাতিক তথ্য বিনিময় নীতিমালা (CBPR ও PRP) স্বীকৃতি।
- ডেটা গোপনীয়তা: ব্যক্তিগত ডেটা গোপনীয়তা নীতিমালায় মার্কিন সরকার ও বেসরকারি খাতের সাথে পরামর্শ।
- সাইবার সিকিউরিটি: সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ ২০২৫-এ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।
- OTT নীতিমালা: ২০২১ সালের OTT নীতিমালা সংশোধন বা বাতিলকরণ।
- স্পেকট্রাম: ৬০০-৭০০ মেগাহার্টস স্পেকট্রাম LPI ও VLP সেবার জন্য উন্মুক্তকরণ।
বিভিন্ন খাতে অশুল্ক বাধা দূরীকরণ
তেরোটি খাতে প্রায় অর্ধশত শর্ত আরোপ করা হয়েছে অশুল্ক বাধা দূরীকরণের জন্য, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- চিকিৎসা সরঞ্জাম: মার্কিন FDA সনদের স্বীকৃতি এবং IMDRF-এর সদস্যপদ গ্রহণ।
- ফার্মাসিউটিক্যালস: FDA অনুমোদিত ওষুধের নিয়ন্ত্রণহীন প্রবেশাধিকার।
- মোটর গাড়ি: মার্কিন গাড়ি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার।
- কৃষি: বিভিন্ন কৃষি উপখাতে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার সনদ স্বীকৃতি ও হালাল সনদ গ্রহণ।
মেধাস্বত্ব সুরক্ষা: আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা
মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে তেরোটি আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনে যুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ব্রাসেলস কনভেনশন, মাদ্রিদ প্রটোকল, সিঙ্গাপুর চুক্তি, প্যাটেন্ট আইন চুক্তি, মারাকেশ চুক্তি।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই শর্তাবলীর ব্যাপকতা বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের জন্যও পূরণ করা কঠিন হবে। বিশেষ করে চীনা পণ্য আমদানি হ্রাস এবং মার্কিন পণ্যের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে।
এনডিএ (গোপনীয়তা চুক্তি) এর অধীনে থাকা এই দলিল ফাঁস হওয়ায় বাংলাদেশের আলোচক দলের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটি ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আলোচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। এই শর্তগুলো স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চীন-বিরোধী অবস্থানে নিয়ে আসতে চায়, যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
অনির্বাচিত সরকারের দুর্বল অবস্থান ও ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জ
বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের জন্য এই কঠোর ও একতরফা মার্কিন শর্তাবলীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন। জনগণের ম্যান্ডেট ও বৈধতা না থাকায় তাদের নৈতিক ভিত্তি এবং রাজনৈতিক সাহস উভয়ই অপ্রতুল। একটি নির্বাচিত সরকার হলে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় অবস্থান নিতে পারত, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশী শক্তির কাছে মাথা নত করা ছাড়া বিকল্প সীমিত। বিশেষত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো মার্কিন প্রিয়পাত্রের নেতৃত্বাধীন এই সরকার যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে, যা ভারত ও চীনের মতো প্রতিবেশী দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সমর্থনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা এই সরকারের অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। জনগণের রায়ের ভিত্তিতে গঠিত সরকার জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন থাকতে পারত, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টিই প্রাধান্য পাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনপুষ্ট এই সরকার আমেরিকার একতরফা দাবিগুলো মেনে নেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে, যা বাংলাদেশকে ভারত ও চীনের সাথে একটি বিপজ্জনক অবস্থানে ফেলে দিতে পারে।
ভৌগোলিকভাবে দুই পরাশক্তির কাছাকাছি অবস্থিত বাংলাদেশের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অত্যাবশ্যক। মার্কিন চাপে চীনবিরোধী অবস্থান নিলে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ফলস্বরূপ, এই ব্যাপক ও আপত্তিজনক শর্তাবলীর মুখে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কার্যত অসহায় অবস্থায় পড়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও নীতিনির্ধারণী স্বায়ত্তশাসনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।