কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে বোমাবর্ষণের নির্দেশ দেন। তার লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে তেহরানের পরমাণু কর্মসূচিকে পঙ্গু করে দেয়া। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়া। কিন্তু এর কয়েক দিনের মাথায় সোমবার হঠাৎ ট্রাম্পের ঘোষিত ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধবিরতি চুক্তি বিশ্বের কূটনৈতিক অঙ্গনে একাধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
যুদ্ধবিরতি, কিন্তু শর্ত কী?
ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে একে “কমপ্লিট অ্যান্ড টোটাল সিজফায়ার” হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধবিরতির বাস্তব শর্তাবলি কিংবা তেহরান ও তেলআবিব ঠিক কী নিয়ে একমত হয়েছে—তা স্পষ্ট নয়। এখনো নিশ্চিত নয় ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু আলোচনা নতুন করে শুরু হবে কি না কিংবা ইরানের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত কী অবস্থায় আছে।
ইসরায়েল বা ইরান সরকারের কেউই এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা নিশ্চিত করেনি। এর মধ্যেই মঙ্গলবার ভোরে ইরান থেকে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের খবর এসেছে। বিরশেবা শহরে এক ভবনে হামলায় চারজন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে ইসরায়েলি জরুরি সেবা সংস্থা।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি জানিয়েছেন, ইসরায়েল তাদের হামলা বন্ধ না করা পর্যন্ত তেহরান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত নয়। তবুও ট্রাম্প প্রশাসন এই সমঝোতাকে “শান্তি সৃষ্টির এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত” হিসেবে চিহ্নিত করছে।
“ট্রাম্প যখন ‘বিশ্বশান্তি’ ঘোষণা করে ফেলেছেন, তখন নেতানিয়াহুর পক্ষে প্রকাশ্যে তার বিপরীতে কিছু বলা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে,” — মন্তব্য করেছেন ওয়াশিংটনের জনস হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ লরা ব্লুমেনফেল্ড।
মার্কিন কৌশলের পেছনে ‘শক্তির মাধ্যমে শান্তি’
ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ বোমা হামলা ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফেরত আনতে বাধ্য করেছে। জাতীয় গোয়েন্দা বিশ্লেষক জোনাথন প্যানিকফ বলছেন, “ইসরায়েল তাদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছে। ইরান একটি ‘এক্সিট’ বা সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এটি যেন সংঘাতের শেষ পর্বের শুরু হয়।”
হুমকি এখনও শেষ হয়নি
তবে বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তবতা আরো জটিল। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সবকিছুই কি ফোরদো, নাতাঞ্জ বা ইসফাহানে সীমাবদ্ধ ছিল? অনেকেই মনে করেন, তেহরান গোপনে অন্য কোথাও আরো উন্নত সুবিধা গড়ে তুলেছে, যা এই হামলার বাইরে রয়ে গেছে।
আরো উদ্বেগের বিষয়—এই যুদ্ধবিরতি কতদিন স্থায়ী হবে—কোনো টাইমলাইন নেই? ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে বহু বছরের ছায়াযুদ্ধ এখন সরাসরি সংঘাতে রূপ নিয়েছে, যার রেশ কাটতে সময় লাগবে।
কী আছে পর্দার আড়ালে?
মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল ড্যান কেইনের মতে, ইরান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাতারে অবস্থিত ঘাঁটিতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল কৌশলগতভাবে সীমিত, যাতে বড় ধরনের যুদ্ধ এড়ানো যায়। ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কোনো হতাহত হয়নি এবং তেহরান ইচ্ছাকৃতভাবেই বড় আঘাত এড়িয়ে গেছে।
এই সূত্রে আরও জানা গেছে, ট্রাম্প সরাসরি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং কাতার ও অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনাও চলে।
শেষ না শুরু?
এই যুদ্ধবিরতি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একদিকে কূটনৈতিক জয়, অন্যদিকে প্রশ্নবিদ্ধ এক ‘বড় জুয়া’। কারণ একদিকে তিনি মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপ না করার অঙ্গীকার ভেঙে সরাসরি সামরিক আগ্রাসনে গেছেন, অন্যদিকে এখন নিজেকে শান্তি-স্থাপনকারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সত্যিকারের শান্তি অর্জনের জন্য ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রভাবশালী মিত্র মিলিশিয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কঠিন আলোচনা এখনও বাকি।
প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক ডেনিস রসের কথায়, “ইরান এখন দুর্বল এবং ইসরায়েল কৌশলগতভাবে এগিয়েছে। কিন্তু স্থায়ী শান্তির জন্য দরকার কঠিন, স্বচ্ছ ও বাস্তবভিত্তিক কূটনীতি। এখনো সব প্রশ্নের উত্তর আসেনি।”
যুদ্ধবিরতি কি টিকবে—তার মতে, “হ্যাঁ, কারণ ইরান এই মুহূর্তে যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন বোধ করছে এবং ইসরায়েল ইতোমধ্যে তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শেষ করেছে।”
তবে রস সতর্ক করেছেন, পরিস্থিতি এখনো জটিল। তিনি বলেন, “ইরান হয়তো দুর্বল হয়ে পড়েছে, কিন্তু তাদের পরমাণু ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী হবে? সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের যে মজুত রয়েছে, তার পরিণতি কী?”
রস মনে করেন, যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে এখন থেকেই জটিল ও কঠিন কূটনৈতিক আলোচনার পথে হাঁটতে হবে, এবং তা সহজ হবে না।